ডেঙ্গু রোগের কারণ-ডেঙ্গু রোগের প্রতিকার
বর্তমান মৌসুমে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেশি দেখা দিয়েছে। এই আর্টিকেলে আমরা
ডেঙ্গু রোগ কি, ডেঙ্গু রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানব। ডেঙ্গু
রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানতে এই পোস্টটি প্রথম থেকে শেষ
পর্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
ডেঙ্গু প্রধানত ক্রান্তীয় অঞ্চল এবং রূপকারবীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে বেশি দেখা
যায়। ডেঙ্গু একটি সাধারণ ভেক্টর বাহিত ভাইরাস জনিত রোগ।
সূচিপত্রঃ- ডেঙ্গু রোগের কারণ-ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
ভূমিকাঃ
বাংলাদেশে বিশেষ করে শহর অঞ্চলের মানুষের কাছে ডেঙ্গু একটি আতঙ্কের নাম। ডেঙ্গু
রোগের আতঙ্কের প্রধান কারণ হলো এই রোগের সুনির্দিষ্ট কোন কার্যকর প্রতিকার নেই
এবং যেকোনো বয়সের মানুষই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত মার্চ থেকে জুন
পর্যন্ত এই সময়ের ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণের হার বেশি হয়ে থাকে। এপ্রিল মাসে এর
সংক্রমণ সর্বোচ্চ শিকড়ে পৌঁছায়। কিন্তু এই বর্ষা মৌসুমেও ডেঙ্গুর সংক্রমণের
হার ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা গেছে।
ডেঙ্গু রোগ কিঃ
ডেঙ্গু হলো মশা বাহিত ভাইরাস জনিত জ্বর। এডিস ইজিপ্ট মশার কামড়ে এই জ্বরের
সংক্রমণ হয়ে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ের ডেঙ্গুভাইরাস বহনকারী ভেক্টর কে সনাক্ত
করার না গেলে রোগী মৃত্যুবরণ করতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি
বেশ ভয়াবহ। ডব্লিউএইচওর একটি প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে যে বাংলাদেশ ঝুঁকির
মধ্যে রয়েছে এবং মহামারীর লক্ষণ সম্পর্কে সতর্ক হওয়া উচিত।
ডেঙ্গু রোগের উৎপত্তিঃ
ডেঙ্গু জ্বরের অপর নাম হল ব্রেকবোন ফিভার (যার সাথে গুরুতর হাড়ের ব্যথার
জন্য নামকরণ করা হয়েছে)। ১৭৮০ সালে বেঞ্জামিন রাস এর প্রথম ক্লিনিক্যাল
রেকর্ডে এই ফিভারটি লক্ষ্য করা যায়। ১৯০৯ সাল থেকে ১৯০৬ সালে মানব
স্বেচ্ছাসেবকদের গবেষণার মাধ্যমে প্রকাশিত হয় যে এই রোগটি মশার মাধ্যমে
সংক্রমিত হয় এবং এটি একটি ভাইরাস দ্বারা তৈরি।
যদিও ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত এ ভাইরাসটিকে পরীক্ষাগারে চূড়ান্তভাবে শনাক্ত করা সম্ভব
হয়নি। ডেঙ্গু দা জয়ের চারটি অ্যান্টি-জেনিকাল ভাইরাসের টাইপ (টাইপ ১-৪)
রয়েছে। এবং পরবর্তীতে এই টাইমগুলোকে ডেঙ্গু জ্বরের কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা
হয়। ১৯৫৪ সালে ফিলিপাইন থেকে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয় ডেঙ্গু রোগ
সংক্রমনের একটি নতুন সিনড্রোম দেখা দিয়েছে।
সেটি হল ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF). বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রথম
প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ১৯৬৪ সালে। এই ডেঙ্গু রোগ প্রায় এক দশক বা তার বেশি
সময় পড়ে আবারও বাংলাদেশে সনাক্ত করা হয়। ১৯৭৭-৭৮ সালে যখন মিরপুরের
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়া ডিজিজ রিসার্চ বাংলাদেশ (ICDDRB) এ কিছু
রোগির মধ্যে ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল।
ডেঙ্গু রোগের প্রকারভেদঃ
ডেঙ্গু জ্বর দুই প্রকার। যথা-১. ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর।
২. ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF)।
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর তুলনামূলক কম বিপদজনক এবং এই রোগে খুব কম রোগী মারা যায়।
অপরপক্ষে, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হল ডেঙ্গু রোগের মারাত্মক রূপ। যেটি একাধিক ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে। ডেঙ্গু রোগের মারাত্মক এই রূপটি ডেঙ্গু ভাইরাসের দ্বিগুণ সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে। তবে ধারণা করা হয় প্রথমটি রোগীকে সমবেদনশীল করে, যখন দ্বিতীয় টি একটি ইমিউনোলজিক্যাল বিপর্যয় তৈরি করে বলে মনে করা হয়।
ডেঙ্গু জ্বরের কারণ কীঃ
ডেঙ্গু রোগ থেকে নিজেকে এবং পরিবারের সদস্যদেরকে নিরাপদে রাখতে হলে ডেঙ্গু
রোগের কারণ সম্পর্কে অবহিত থাকতে হবে। এডিস মশা মানুষকে কামড় দিলেই যে তার
ডেঙ্গু হবে বিষয়টি এমন নয়। চিকিৎসকরা বলেছেন, ডেঙ্গু রোগের ভাইরা যদি কোন
এডিস মশার মধ্যে সংক্রমিত হয় এবং ওই সংক্রমিত মশা যদি কোন মানুষকে কামড়ায়
তবেই সে মানুষের ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পুরুষ এডিস মশা ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস বহন করে না। স্ত্রী এডিস মশার মাধ্যমে এ
রোগের ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে। এবং সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে সুস্থ ব্যক্তিদেরও এই
ভাইরাস ছড়াতে পারে। কোন রোগী দ্বিতীয়বারের মতো ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হলে তার
প্রাণনাশের আশঙ্কা বেড়ে যায়।
ডেঙ্গু রোগের লক্ষণঃ
ডেঙ্গু জ্বরের প্রার্দভাবকে প্রতিহত করতে হলে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ সম্পর্কে
আমাদের সচেতন থাকা উচিত।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) এর লক্ষণঃসাধারণত DHF-এ রোগীরাদের মল, বমি এবং নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে-
- মাত্রাতিরিক্ত জ্বর হতে পারে।
- হাড় এবং পেশীতে ব্যথা অনুভূত হওয়া।
- কাশি এবং সর্দি।
- চোখ লালচে ভাব এবং সংবেদনশীল হতে পারে।
- ড্যানহোকা; ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।
- হেমোরেজিক ফিভার এর বিশেষ লক্ষণঃ
- রোগীর পেটে ব্যথা এবং বমি হতে পারে। যা ২-৪ দিন স্থায়ী হয়ে থাকে।
- রোগীর নাক, মারি এবং ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এছাড়াও মলদ্বার দিয়ে রক্তপাত, কালো ট্যারি মল, এবং অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হতে পারে।
- ত্বকে লাল রেনপ্রিক আকারের দাগ দেখা দিতে পারে।
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু রোগের সাধারণ লক্ষণগুলি এবং ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার লক্ষণ
গুলি প্রায় একই। তবে ডেঙ্গু হিমোলজিক ফিভারের তুলনায় ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর
কম বিপদজনক। কয়েকদিনের মধ্যে রোগী সেরে ওঠার লক্ষণ দেখা দেয়। ক্লাসিক্যাল
ডেঙ্গু জ্বরে রক্তের প্লাটিলেটের সংখ্যা কমে যেতে পারে কিন্তু কোন রক্তক্ষরণ
হয় না।
সহায়ক এজেন্ট এবং ভেক্টরঃ
ডেঙ্গু জ্বর বা ডেঙ্গু রক্তক্ষরণজনিত জ্বর বি-আরবোভাইরাস (ফ্ল্যাভিভাইরাস) একটি
গ্রুপ দ্বারা সৃষ্ট এবং যারা স্টেরিওটাইপ 1,2,3 এবং 4 (Den-5, Den-2, Den-3 and
Den-4) অন্তর্ভুক্ত। এই ভাইরাসের ইনকিউভেশান পিরিয়ড সাধারণত ৫-৬ দিন
তবে ৩ থেকে ১০ দিনের মধ্যে পরিবর্তিত হতে পারে। এডিস ইজিপ্টাই ডেঙ্গু
ভাইরাসের প্রধান বাহক।
আরো পড়ুনঃ ডায়াবেটিস থেকে বাঁচার ২০ টি উপায়
তাই ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাবের জন্য এডিস অ্যালবোপিকটাস, এডিস পলিনেসিনসিস এবং
এডিসের অন্যান্য কিছু প্রজাতিকে দায়ী করা হয়। এডিস ইজেপ্টির গায়ে এবং পায়ে
বাঘের মত সাদা ডোরাকাটা দাগ থাকে। তাই এদেরকে‘টাইগার মসকুইটো’ বলা হয়।
ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণের বিস্তার পদ্ধতিঃ
ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব কমানোর জন্য এ রোগের সংক্রমণের পদ্ধতি সম্পর্কে
জ্ঞান থাকা আবশ্যক।সাধারণত স্ত্রী এডিস এজিটটি মশার কামড়ে এই রোগ হয়ে থাকে।
এডিস মশাগুলো দিনের বেলায় কামড়ায়। এই ভাইরাসের সংক্রমিত নয় এমন এপ্রিল
মশা কোনো সংক্রমিত ব্যক্তিকে কামড়ালে ওই মশার ভেতরেও এই ভাইরাসের সংক্রমণ হয়।
এবং ওই সংক্রমিত মশা কোন সুস্থ মানুষকে কামড়ালে সে ব্যক্তিরও ডেঙ্গু রোগ হতে
পারে।
এডিস মশাগুলো সাধারণত পায়খানা এবং অন্যান্য অন্ধকার জায়গায় বিশ্রাম নেয়।
স্ত্রী এডিস মশা গুলো বাসা বাড়ি, স্কুল এবং কলেজের, বা কর্মস্থলের ওভারহেড
ট্যাঙ্ক, ফেলে দেওয়া বালতি, টায়ার, বাসনপত্র, বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য
ব্যবহৃত বড় পাত্র, এবং আশেপাশে বিভিন্ন ধরনের জায়গা যেখানে পানি জমে থাকে সে
সকল বদ্ধ পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে।
মশার ডিম থেকে লার্ভা বের হয়ে প্রায় এক সপ্তাহ সেই পানিতে থাকে এবং
দু-একদিনের মধ্যে একটি বৃত্তাকার পেপাল পর্যায়ে পরিণত হয়। এবং মশাটি
প্রাপ্তবয়স্ক হয় এবং কামড়ানোর জন্য প্রস্তুত হয়। এডিস মশার সাধারণত ৪০০
থেকে ৫০০ মিটার সীমিত দূরত্ব পর্যন্ত উঠতে পারে। তবে মানুষের ব্যবহৃত বিভিন্ন
যানবাহনের মাধ্যমে এরা বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে।
ডেঙ্গু রোগের নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থাঃ
ডেঙ্গু রোগ সম্পর্কে বাঁচতে হলে ডেঙ্গু রোগের কারণ, ও লক্ষণ জানার পাশাপাশি
অবশ্যই ডেঙ্গু রোগের নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন হতে
হবে।
মশার কামড় প্রতিরোধ করুনঃ- রোগের প্রাদুর্ভাব পরিস্থিতিতে মশার কামড় থেকে বাঁচতে হাত পা ঢেকে রাখার জন্য ফুলহাতা কাপড় বা লম্বা পোশাকের ট্রাউজার পরুন।
- দিনের বেলায় মশার কয়েল এবং বৈদ্যুতিক বাষ্পের ম্যাট বা স্প্রে ব্যবহার করুন।
- সুস্থ ব্যক্তিদের মশার কামড় থেকে রক্ষা করতে আক্রান্ত রোগীকে মশারির ভেতরে রাখুন এবং এই মশারি ডেঙ্গুর বিস্তার বন্ধ করতে সহায়তা করে।
এডিসে মশার বংশবৃদ্ধি রোধ করুনঃ
- এয়ার কুলার, ট্যাঙ্ক, ব্যারেল, ড্রাম এবং বালতি, অবব্যবহৃত বাসনপত্র যেগুলোতে পানি জমে থাকে এবং ড্রেনের পানি পরিষ্কার করুন এবং কীটনাশক স্প্রে করুন।
- সকল ধরনের পানির পাত্র ঢেকে রাখুন।
- রেফ্রিজেরেটারে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করুন।
এডিস এজিপ্টি মশার বংশ বৃদ্ধি রোধের জন্য নিম্নলিখিত
প্রোগ্রামগুলি নেয়া যেতে পারেঃ
- ডেঙ্গু রোগ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য প্রচুর সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ এবং এটি কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে সে বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা করা যেতে পারে।
- ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিনামূল্যে পরীক্ষার সুবিধা এবং যথাযথ চিকিৎসার সুবিধা।
- মশার বংশ নির্মূলে সিটি কর্পোরেশনগুলোকে নিয়মিত কীটনাশক স্প্রে করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
উপসংহারঃ
প্রতিবছরের ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেড়ে চলেছে। হয়তো ভবিষ্যতে এর প্রকোপ আরো
খারাপ রূপ ধারণ করতে পারে। সুতরাং, ভবিষ্যৎ ভয়াবহতার কথা মাথায় রেখে সরকারকে
উপলব্ধি করা উচিত যে পূর্বে অজানা বা অল্প জানা ভাইরাল রোগের হঠাৎ মহামারী
প্রাদুর্ভাব জনসাস্থ্যের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে।
সেইসাথে প্রযুক্তিগত মানব সম্পদের বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। তাই সরকারি
এবং বেসরকারি, সহ জনসাধারণকে এই দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য একত্রে কাজ করতে হবে।
তাছাড়া ভবিষ্যতে, ডেঙ্গু বিশ্বের এই অংশে সংক্রামক রোগের মহামারীর একটি নতুন
বাস্তবতার আশ্রয়স্থল হতে পারে।
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url