গ্রীন হাউস ইফেক্ট কি-গ্রিন হাউস ইফেক্টের কারণ
গ্রিন হাউস ইফেক্ট কি ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বর্তমান বিশ্বের এটি একটি উদ্বেগ।
গ্রীন হাউস ইফেক্ট বিভিন্ন দিক দিয়ে মানব জীবনের জন্য হুমকি। গ্রিন হাউস
ইফেক্টের প্রভাব এর ফলে
জলবায়ু পরিবর্তন
হচ্ছে। ফলে পরিবেশ ও কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দিচ্ছে।
আজকে আমরা গ্রিন হাউস ইফেক্ট কি, গ্রিন হাউস ইফেক্টের কারণ সম্পর্কে আলোচনা করব।
সূচিপত্রঃ- গ্রিন হাউস ইফেক্ট কি- গ্রিন হাউস ইফেক্টের কারণ
ভূমিকাঃ
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে মানব সভ্যতার অগ্রগতিকে খুব দ্রুত ত্বরান্বিত করছে।
বিজ্ঞানের বৈচিত্র্যপূর্ণ বিস্ময়কর অবদানের ফলে মানব জাতি যেমন সভ্যতার স্বর্ণ
শিখরে উপনীত হয়েছে, তেমনি বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ক্ষতিকর প্রভাব গুলো মানবজাতিকে
একটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যে কারণে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস হয়ে
যাচ্ছে এবং পৃথিবী চরম দুর্দিনের সম্মুখীন হচ্ছে।
পরিবেশ দূষণের
ফলে দিন দিন গ্রীনহাউস ইফেক্ট বেড়ে যাচ্ছে। মূলত গ্রিন হাউস ইফেক্ট পরিবেশ
দূষণের এমন এক বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া যা বিশ্ববাসীকে এক নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে
দাঁড় করিয়েছে। প্রকৃতি হারিয়ে ফেলেছে তার ভারসাম্য ও স্বাভাবিক গতি।
গ্রিন হাউস কিঃ
ইংরেজি ‘Green House’ শব্দের অর্থ হল 'সবুজ ঘর'। ক্যান্টিনেভিয়ান দেশসমূহ
এবং মেরু অঞ্চলে সূর্যালোকের স্বল্পতার কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় শাক সবজির
উৎপাদনের ক্ষেত্রে তীব্র সংকট দেখা দেয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য
বিজ্ঞানীরা বিশেষ ধরনের একটি গাছের ঘর উদ্ভাবন করেন। এই কাচের ঘরের মধ্যে নিত্য
প্রয়োজনীয় শাকসবজি এবং ফসল উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হয়।
এই ঘরের ছাদ ও দেয়াল একটি বিশেষ ধরনের তাপ বিকিরণরোধী কাচ দিয়ে তৈরি।
গ্রীষ্মকালে এই ঘরের মধ্যে সূর্যালোক ও উত্তাপ প্রবেশ করে কিন্তু বিকিরণের
মাধ্যমে তা বের হতে পারে না এবং এই ঘরের ভেতরের পরিবেশটা উত্তপ্ত থাকে। যার ফলে
সঞ্চিত সূর্য তাপের বৈরী এবং শীতার্ত পরিবেশে ও শাকসবজি উৎপাদন করা সম্ভব হয়।
বিজ্ঞানীরা এই বিশাল ধরনের ঘরের নাম দিয়েছেন ‘গ্রীন হাউজ বা সবুজ ঘর’।
গ্রিন হাউস গ্যাস (Green House Gas):
যে সকল গ্যাস ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার বিকিরণে বাধা প্রদান করে সে সকল গ্যাস কে
গ্রীন হাউজ গ্যাস বলে। গ্রিন হাউস গ্যাসগুলো হলো-
কার্বন ডাই অক্সাইড(CO2) ৪৯%মিথেন (CH4) ১৮%
ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন (CFC) ১৪%
নাইট্রাসঅক্সাইড (N2O) ০৬%
অন্যান্য (জলীয় বাষ্প) ১৩%
গ্রিন হাউস ইফেক্ট কিঃ
১৮৯৬ সালে “গ্রীন হাউস ইফেক্ট” কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন সুইডেনের রসায়নবিদ
সোভনটে এবং হেনিয়াস। পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ থেকে বায়ুমন্ডলে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত
‘ওজন’ নামের একটি স্তর পৃথিবীর চারপাশকে ঘিরে রেখেছে। এই স্তরকে ওজোন স্তর বলা
হয়। এই ওজন স্তরের ঘনত্ব সব জায়গায় এক রকম নয়। ২৩ কিলোমিটার এর মধ্যে ওজোন
স্তরের ঘনত্ব অপেক্ষা কম। ওজোন স্তরে রয়েছে মূলত কার্বন ডাই অক্সাইড এবং
অন্যান্য কয়েকটি গ্যাসের বেষ্টনী।
আরো পড়ুনঃ জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা
এই গ্যাস গুলোকে একত্রে গ্রীন হাউস গ্যাস বলা হয়।গ্রীন হাউস ঘরের মতো এই গ্যাসের
বেষ্টনীটি দেয়ালের মতো কাজ করে। গ্রীন হাউজের কাঁচের দেয়াল যেমন ভেতরের তাপকে
বিকিরণ হতে বাধা সৃষ্টি করে, তেমনিভাবে বায়ুমন্ডলে সৃষ্ট রাসায়নিক পর্দা বা
গ্যাসের দেয়াল ভূপৃষ্ঠের শোষিত তাপের বিকিরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে। গ্যাসের
এই বেষ্টনীর জন্যই পৃথিবী কর্তৃক শোষিত সামান্য তাপ ভূপৃষ্ঠেই থেকে যায়।
যার প্রভাবে বায়ুমণ্ডল উষ্ণ থাকে। ফলে পৃথিবীতে যে উষ্ণতা থাকে তা জীবের পক্ষে
বাসযোগ্য হয়। জীবের বসবাসের অনুকূল এরূপ পরিস্থিতিকে বলা হয় গ্রিন হাউস ইফেক্ট।
গ্রিনহাউস গ্যাস গুলো সাধারণত পৃথিবীতে সূর্যের আলো আশাকে বাঁধা প্রদান করে না
কিন্তু কৃষ্ণ যে তাপ শোষণ করে সেই তার বিকিরণে বাধা প্রদান করে। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের
তাপ বায়ুমন্ডলে যেতে পারে না পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসে। যার ফলে পৃথিবীতে
তাপমাত্রা আটকে উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গ্রিন হাউস ইফেক্টের প্রধান কারণঃ
গ্রীন হাউজ সম্পর্কে ফ্রান্সের গণিতবিদ জোসেফ ফুরিয়ার ১৮২৪ সালে তার এক বক্তব্যে
বলেছিলেন,“পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল একটি “হটবক্স” – যা একটি হিলিয়াম থার্মোমিটার এর
মত কাজ করে।” পৃথিবী বেষ্টনকারী বায়ুমণ্ডলের কারণে পৃথিবী বাসোপযোগী হয়েছে।
মহাশূন্যের আবহাওয়ামণ্ডলে 'ওজোনস্তর নামে অদৃশ্য এক বেষ্টনী বিদ্যমান।
এই ওজোন স্তর সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে আসার ক্ষেত্রে বাধা
প্রদান করে। এবং পৃথিবী কর্তৃক শোষিত তাপ বিকিরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মহাশূন্যে
পুনরায় ফেরত যেতে সাহায্য করে। মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন দূষণের ফলে পৃথিবীর
এই প্রাকৃতিক নিরাপত্তা বেষ্টনি ওজোন স্তর ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে।
গ্রীন হাউজ ইফেক্টের প্রধান কারণ সমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার বৃদ্ধিঃ
বর্তমানে সভ্যতার উন্নতির ফলে কয়লা, পেট্রোল, ডিজেল, অকটেন সহ বিভিন্ন জীবাশ্ম
জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সকল জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে প্রচুর
পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড এর মত বিষাক্ত
গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে। আমরা বাসা বাড়িতে যে সকল পণ্য যেমন-ফ্রিজ এয়ারকন্ডিশনার
বিভিন্ন রকমের স্প্রে ইত্যাদি ব্যবহার করি এগুলো থেকে ক্লোরোফ্লোরো কার্বন বা
সিএফসি গ্যাস উৎপন্ন হয়।
বিশেষ করে শিল্প কারখানা গুলোতে এই ক্ষতিকর গ্যাসের ব্যবহার ব্যাপক। এই সি এফ সি
গ্যাস মহাশূন্যের ওজোন স্তর ক্ষয় করার জন্য এক অন্যতম উপাদান। এছাড়াও বড় বড়
শিল্প-কারখানা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া থেকে প্রতিনিয়ত নির্গত হচ্ছে
কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন প্রভৃতি ক্ষতিকর গ্যাস।
আরো পড়ুনঃ জলবায়ু পরিবর্তন রোধের উপায়
শুধুমাত্র জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো এবং বিভিন্ন শিল্পকারখানা থেকে যে পরিমাণ
কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস নির্গমন হয় তা মোট গ্রীন হাউজ গ্যাসের ৬৫ শতাংশ। যে
গ্যাস গুলো গ্রিনহাউজ ইফেক্ট তৈরির জন্য দায়ী সেগুলো হল- কার্বন-ডাই অক্সাইড,
মিথেন, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরো ফ্লোরো
কার্বন (CFC) ও ওজোন ইত্যাদি।
বৃক্ষনিধোনঃ
গ্রীন হাউস ইফেক্ট এর আরো একটি প্রধান কারণ হলো বনভূমি উজাড় করা। আমরা জানি সবুজ
গাছপালা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের খাবার তৈরির জন্য বায়ুমণ্ডল
থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস, মাটি থেকে পানি এবং সূর্যালোক থেকে শক্তি গ্রহণ
করে। বনভূমি উজাড়ের ফলে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণের হার
বিপদজনকভাবে কমে গেছে।
যার ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। যেটি গ্রীন
হাউস ইফেক্ট এর তীব্র তাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। সামগ্রিকভাবে
পরিবেশ
বিপন্ন হওয়ার ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে।
নাইট্রোজেন সারের অত্যাধিক ব্যবহারঃ
বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দিন দিন কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তাই স্বল্প
পরিমাণ জমিতে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষকরা রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল
হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে নাইট্রোজেন স্যারের ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি হয়েছে।
নাইট্রোজেন সারের ব্যবহারের ফলে বাতাসে নাইট্রাস অক্সাইড এর পরিমাণ বৃদ্ধি
পাচ্ছে। নাইট্রোজেন বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়ার মাধ্যমে নায়িকা অক্সাইড
গ্যাস উৎপন্ন করে।
বর্জ্য ও মিথেন গ্যাসঃ
মিথেন গ্যাস উৎপন্নের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে আবর্জনা, মৃত উদ্ভিদ এবং
প্রাণী, এবং গবাদি পশুর মলমূত্র। বিশেষ করে যে সকল পুকুরের আশেপাশের প্রচুর কাজ
রয়েছে সেই গাছপালা থেকে পতিত পাতা পুকুরের মাটিতে পচে প্রচুর পরিমাণে গ্যাস
উৎপন্ন করে। গ্রীন হাউজ ইফেক্ট এর প্রভাবে বায়ুমন্ডলে এই ক্ষতিকারক গ্যাস গুলোর
মাত্রা বৃদ্ধির ফলে ভূপৃষ্ঠের তাপ বিকিরণে বাধা প্রদান করছে।
এবং সূর্য থেকে আসা কিছু তাপ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে আটকে রাখছে।ফলে ওজোন স্তর ক্ষয়
হওয়ার কারণে মাত্রাতিরিক্ত সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে এসে পৌঁছাচ্ছে এবং
বায়ুমন্ডলে প্রতিনিয়ত তাপ জমা হচ্ছে। ফলে পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
উপসংহারঃ
বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্ব এই গ্রিনহাউজ ইফেক্ট ক্ষতিকর প্রভাবের এর শিকারে পরিণত
হয়েছে। ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশকে গ্রীন হাউজ ইফেক্ট এর ভয়াবহ ফলাফল ভোগ করতে
হতে পারে। গ্রীন হাউস গ্যাস উৎপন্ন বাংলাদেশের ভূমিকাতে অবস্থানগতভাবে ভৌগোলিক
কারণটাই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মতো একটি ছোট এবং উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে একাই
গ্রীন হাউস ইফেক্ট প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা ক্ষমতা ও সামর্থ্য খুবই নগণ।
মানব জাতিকে ভবিষ্যতে গ্রীন হাউস ইফেক্ট এর প্রভাব থেকে রক্ষা করতে হলে কৌশলগত
ভাবে অগ্রসর হতে হবে।
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url