হিমোগ্লোবিন কি - রক্তে হিমোগ্লোবিনের কাজ কি
হিমোগ্লোবিন রক্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হিমোগ্লোবিনের অভাবে বিভিন্ন রকম
সমস্যা দেখা দিতে পারে।মানব শরীর একটি জটিল ও সুসংগঠিত কোষ দ্বারা গঠিত। এই
সুসংগঠিত পোস্টগুলো মানুষের জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দিষ্ট
কাজগুলো একসাথে সম্পন্ন করে থাকে। বাইরে থেকে মানবদেহে দেখতে খুবই সাধারণ।
যাতে হাত-পা মুখ, চোখ, কান ইত্যাদি অঙ্গ রয়েছে। মানব শরীরের প্রতিটি অঙ্গের
খুব জটিল এবং তাৎপর্যপূর্ণ গঠন আছে। যেমন- কোষ, টিস্যু, অঙ্গ, বিভিন্ন সিস্টেম
ইত্যাদি। মানব শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল রক্তের হিমোগ্লোবিন। আজকের
এই প্রবন্ধে হিমোগ্লোবিন কি, হিমোগ্লোবিনের কাজ কি, হিমোগ্লোবিনের অভাবে কি কি
হতে পারে এ বিষয়গুলো আলোচনা করব।
সূচিপত্রঃ- হিমোগ্লোবিন কি - রক্তে হিমোগ্লোবিনের কাজ কি
হিমোগ্লোবিন কিঃ
রক্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে হিমোগ্লোবিন। এই হিমোগ্লোবিন রক্তে বাহক
হিসেবে কাজ করে। রক্তের ঘনত্ব বজায় রাখা এবংরক্ত লাল হওয়ার জন্য এই
হিমোগ্লোবিনের ভূমিকা রয়েছে। হিমোগ্লোবিন হচ্ছে লৌহঘটিত প্রোটিন বা
মেটালোপ্রোটিন যা মেরুদন্ডী প্রাণীদের লোহিত রক্তকণিকায় পাওয়া যায়। তবে কিছু
কিছু অমেরুদন্ডী প্রাণীর রক্ত পাওয়া যায়। হিমোগ্লোবিন সংক্ষেপে Hgb বলা হয়।
মানব দেহের অস্থি মজ্জা (Bone Marrow) থেকে হিমোগ্লোবিন তৈরী হয়।
রক্তে হিমোগ্লোবিনের কাজ কিঃ
হিমোগ্লোবিনের প্রধান কাজ হচ্ছে অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড বহন করা।
প্রশ্বাসের মাধ্যমে আমরা যে অক্সিজেন গ্রহণ করি তা সরাসরি ফুসফুসে জমা হয়।
ফুসফুস থেকে রক্তের হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত হয়ে অক্সি হিমোগ্লোবিন
(Oxy-hemoglobin) যৌগ গঠন করে। এই অক্সিজেনেটেড (Oxygenated) যৌগ রক্তের
মাধ্যমে মানুষের কোষে পৌঁছায়। যার মাধ্যমে মানব কোষ শক্তি উৎপাদন করে।
আরো পড়ুনঃ ডেঙ্গু রোগের কারণ-ডেঙ্গু রোগের প্রতিকার
শক্তি উৎপাদন শেষে উৎপন্ন কার্বন ডাই-অক্সাইড হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত হয়ে
(Deoxygenated) আবারো ফুসফুসে ফিরে আসে। এবং নিঃশ্বাসের সাথে আমরা ত্যাগ করি।
এছাড়া এই হিমোগ্লোবিন রক্তে বিভিন্ন ধরনের দূষিত পদার্থ মিশতে বাধা প্রদান
করে। আমরা আগে জেনেছি যে রক্ত লাল হওয়ার কারণ কি। রক্ত প্রদানত হিমোগ্লোবিনের
জন্য লাল হয়ে থাকে। রক্তের সাথে অন্যান্য উপাদান পর্যাপ্ত পরিমাণে
রয়েছে। রক্তের মাধ্যমেই অক্সিজেন শরীরের প্রতিটি অঙ্গ এবং প্রত্যঙ্গে
অনুপাতে থাকে।
এছাড়াও এই রক্তের মাধ্যমে মানুষের শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান শরীরের
প্রতিটি কোষে পৌঁছায়। রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে প্রধানত অক্সিজেনের স্বল্পতা
দেখা দেয়। যার ফলে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হতে পারে। সুতরাং এটা
নিশ্চিত যে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য হিমোগ্লোবিনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রক্ত থেকে দূষিত এবং ক্ষতিকার পদার্থ শরীর থেকে বের করতে সাহায্য করে এবং
রক্তের সাথে ক্ষতিকর পদার্থ মিশ্রণে বাধা প্রদান করে।
মানুষের শরীরের রক্ত কণিকার ৯৬ - ৯৭ % হল হিমোগ্লোবিনের প্রোটিন অংশ। আমাদের
শরীরের রক্তের মোট ওজনের (পানিসহ) ৩৫ শতাংশ হল হিমোগ্লোবিন। মানব
শরীরের প্রতি ১ গ্রাম হিমোগ্লোবিন বাতাস থেকে প্রতিবার প্রায় ১.৩৬ মিলিলিটার,
অনেক সময় এর চাইতে বেশি অক্সিজেন গ্রহণ করে থাকে। যার ফলে রক্তে এর পরিবহণের
মাত্রা প্রায় ৭০ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। মানব শরীরের শতকরা ৯৭ ভাগ
অক্সিজেন ফুসফুস থেকে হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে পৌঁছায়। এবং
বাকি তিন ভাগ রক্তের প্লাজমায় মিশে থাকে।
হিমোগ্লোবিন রক্তের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ থেকে উর্ধ্বে ১০০ বার পর্যন্ত অক্সিজেন
মুভ করাতে পারে। ফুসফুসের মধ্যে অক্সিজেন লেভেল যেখানে বেশি থাকে,
হিমোগ্লোবিন সেখানে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রাখতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ যে
স্থানে অক্সিজেন বেশি থাকে সেই স্থান থেকে অক্সিজেন নিয়ে যে স্থানে অক্সিজেনের
পরিমাণ কম সেখানে পৌঁছে দেয়। হিমোগ্লোবিনের প্রতিটি অনুর ৪টি আয়রণ পরমাণু
থাকে। আর প্রতিটি আয়রণ পরমাণু একটি করে অক্সিজেন গ্রহণ করে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক
মানুষের প্রতি 100 ml রক্তে হিমোগ্লোবিনের গড় পরিমাণ 14.5 mg ( নারী ও পুরুষ
ভেদে এই পরিমাণ পরিবর্তনশীল )।
হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক পরিমাণ কতঃ
রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা নারী ও পুরুষ ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। মানব শরীরের
হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বয়স লিঙ্গ অথবা পরবর্তী রোগ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রভাবিত
হয়। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের রক্তে গড় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা
নারীদের তুলনায় সামান্য বেশি হয়ে থাকে। প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের ক্ষেত্রে গড়
হিমোগ্লোবিনের মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে (g/dL) ১৩.৫-১৭.৫ গ্রাম। এবং নারীদের
ক্ষেত্রে ((g/dL) ১২-১৫.৫ গ্রাম।
শিশুদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কতঃ
সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চেয়ে শিশুদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বেশি
থাকে। হিমোগ্লোবিন যেহেতু লোহিত রক্ত কণিকায় থাকে সেহেতু শিশুদের লোহিত রক্ত
কণিকার সংখ্যাও বেশি। কিন্তু জন্মের কয়েক সপ্তাহ পরে এই রক্তকণিকার মাত্রা
কমতে থাকে। জন্মের পর লোহিত কণিকার মাত্রা ছেলে-মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে সমান
থাকে। তবে ১২ বছর বয়সের পর থেকে শিশুদের রক্তে লোহিত কণিকার মাত্রা লিঙ্গ ভেদে
পরিবর্তন হয়ে থাকে।
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত থাকা দরকারঃ
আমরা সবাই জানি যে গর্ব অবস্থায় মহিলারা রক্তশূন্যতায় ভুগে থাকেন। কিন্তু এর
কারণ কি? অন্যান্য কারণ গুলোর মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে গর্ভাবস্থায় শিশুরা তার
প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান তার মায়ের শরীর থেকে গ্রহণ করে থাকে। যার ফলে
মায়ের লোহিত রক্ত কণিকার ঘনত্ব কমতে থাকে।
ফলে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়। তাই গর্ভবতী মহিলারা রক্তশূন্যতার সহ
অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্মুখীন হয়। মায়ের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে গেলে
শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ ব্যাহত হতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় একজন মহিলার নিয়মিত
হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করা আবশ্যক।
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা হলোঃ
ট্রাইমেস্টার = ত্রৈমাসিক
প্রথম ট্রাইমেস্টারঃ ১১.৬ - ১৩.৯ গ্রাম/ডেসিলিটার (g/dL)
দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারঃ ৯.৭-১৪.৮ গ্রাম/ডেসিলিটার (g/dL)
তৃতীয় ট্রাইমেস্টারঃ ৯.৫-১৫.০ গ্রাম/ডেসিলিটার (g/dL)
রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণ কিঃ
অনেক কারণে একজন মানুষের শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যেতে পারে। পুষ্টি
জনিত কারণ এর মধ্যে রয়েছে ফলিক এসিড, আয়রন, ভিটামিন বি১২, ভিটামিন সি
ইত্যাদির অভাব। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের রোগ যেমন- ক্যান্সার, কিডনির সমস্যা,
এইডস, লিউকোমিয়া, একাধিক মেলোমা (Multiple Myeloma), লিভার সিরোসিস, লিম্ফোমা,
জিনগত সমস্যা ইত্যাদি। এছাড়া কেটে যাওয়া বা ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ক্ষরণের
মাধ্যমে হিমোগ্লোবিনের অভাব হতে পারে। অপুষ্টির কারণে গর্ভাবস্থায় মায়েদের
হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি হতে পারে।
হিমোগ্লোবিনের অভাবে কি রোগ হয়ঃ
শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে গেলে অক্সিজেনের সরবরাহ কমে যায়। ফলে শরীরে
বিভিন্ন ধরনের রোগ দেখা দিতে পারে। রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে
অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। শিশুদের ক্ষেত্রে অ্যানিমিয়া সহ
অনকোলজি, পেটের সমস্যা, সংক্রামক রোগ, অটোইমিউন (Autoimmune Disease) ও
বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতা সহ বিভিন্ন রোগ দেখা দিতে পারে।
হিমোগ্লোবিন কমে গেলে করণীয় কিঃ
রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যাওয়াকে রক্তশূন্যতা বলে। তাই রক্তশূন্যতা দূর
করার জন্য হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে হবে। আয়রন, ভিটামিন বি১২, ভিটামিন সি
এবং ফলিক অ্যাসিড যুক্ত খাবার খেয়ে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ানো যেতে পারে।
তবে ওরাল আয়রন সাপ্লিমেন্ট এর ক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী
খেতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে মায়েদের উচিত আয়রন যুক্ত খাবার বেশি বেশি খাওয়া।
একজন মায়ের খাদ্য তালিকায় অবশ্যই মাংস (যকৃত, জিহ্বা, গরুর মাংস) এবং বাদাম
ফল শাকসবজি লেবু অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত। ৬ মাস বয়স ঊর্ধ্ব শিশুদেরকে ধীরে ধীরে
চর্বিহীন মাংস সামুদ্রিক মাছ, শাকসবজি এবং ফলমূল খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
এছাড়া গর্ভবতী মহিলাদের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখতে এবং আয়রনের শোষণ ঠিক
রাখতে ক্যাফিন এবং গ্লূটেন যুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে।
উপসংহারঃ
সবশেষে সুস্থ থাকাটাই আসল। একজন মানুষের সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর
খাবার খেতে হবে। নিয়মিত শরীর চর্চা বা ব্যায়াম করতে হবে। শরীরকে সুস্থ রাখার
জন্য অবশ্যই ধূমপান, মধ্যপান সহ অন্যান্য অ্যালকোহল জাতীয় পানীয়, ক্ষতিকর
খাবার থেকে বিরত থাকতে হবে।
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url