জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা

জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা বর্তমান বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপনীত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে সমস্যার সবচেয়ে বড় কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি— যার ফলে আবহাওয়া পরিবর্তিত হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে এবং বিশ্ব নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা
বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণ বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং এই তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ গ্রিন হাউস ইফেক্ট।

সূচিপত্রঃ-জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা

ভুমিকাঃ

সূর্য থেকে আগত তাপশক্তি পৃথিবীপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে এবং এ বিকিরিত তাপশক্তির অধিকাংশই পুনরায় বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়। কিন্তু মানবসৃষ্ট দূষণ এবং বনভূমি উজাড় করার ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে, যা কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের সমন্বয়ে গঠিত।
এর ফলে বিকিরিত তাপশক্তি পুনরায় বায়ুমণ্ডলে ফিরে যাওয়ার পথে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং এভাবেই বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির করো বর্তমান বিশ্ব প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম ।

বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা

বর্তমান বিশ্বে আলোচিত ও ভয়াবহ সমস্যাগুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা অন্যতম। এর ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দিচ্ছে বিশ্বজুড়ে। আর এ সমস্যার কাতারে শামিল হচ্ছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিশেষ উন্নয়নশীল দেশগুলো । নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
(১) সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাঃ বৃদ্ধি জলবায়ু পরিবর্তনের একটি সম্ভাব্য পরিণতি হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির দরুন ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রের পানির উত্তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পানি সম্প্রসারিত হয়ে সমুদ্রের আয়তন ও পরিধিকে বাড়িয়ে তুলছে। উষ্ণায়নের ফলে হিমালয়সহ অন্যান্য পর্বতচূড়ায় জমে থাকা বরফ গলে যাচ্ছে এবং সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে।
এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্লাবিত এলাকার পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। উত্তর ও দক্ষিণমেরুর গ্রীনল্যান্ড, অ্যান্টার্কটিকাসহ অন্যান্য ভূভাগের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়িয়ে তুলছে। এভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা ১° সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের ১৯ শতাংশ ভূমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। এর ফলে ৫৫ মিলিয়ন লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
(২) মরুভূমির বৈশিষ্ট্যঃ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে একদিকে যেমন পৃথিবীর নিষ্ঠু এলাকাসমূহ সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে মরুভূমির বৈশিষ্ট্য দেখা দেবে।
সাম্প্রতিককালে ভূ-পৃষ্ঠে পানির পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ফলে সমগ্র ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর ফলে কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হবে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ইতোমধ্যে মরুভূমির বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়েছে। এর ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহতসহ তা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
(৩) নিম্নভূমিতে প্লাবনঃ জলবায়ু পরিবর্তনের হেতু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার বর্গ কিমি এলাকা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। পরিবেশবিজ্ঞানীদের মতে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এই শতাব্দীর শেষ দিকে ২০-৬০ সেমি পর্যন্ত বাড়তে পারে জলবায়ু পরিবর্তিত হলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যাবে এবং নদ-নদীর পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। আমাদের দেশের অধিকাংশ নদীর উৎস দেশের বাইরে ভারত ও নেপালে। তাই একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও অপরদিকে ব্যাক ওয়াটার ইফেক্ট যুক্ত হয়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করবে।
(৪) জীববৈচিত্র্য ধ্বংসঃ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার প্রভাবে বনাঞ্চলসমূহ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী বিলুপ্তির পথে। পরিবেশ ও ভূবিজ্ঞানীদের মতে, সমুদ্রের উচ্চতা মাত্র ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে সুন্দরবনের ৭০ ভাগ তলিয়ে যাবে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেলে তা বিশ্বের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ
ফলাফল বয়ে আনবে। পরিবেশ তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে।
(৫) নদ-নদীর প্রবাহ হ্রাস এবং পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধিঃ বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। জমিতে সেচ ও নৌ-চলাচলের জন্য নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ও দূরবর্তী দ্বীপসমূহের প্রায় ১.৪ মিলিয়ন হেক্টর এলাকায় লোনা পানি প্রবেশ করায় উন্মুক্ত জলাশয় ও ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে এই লবণাক্ততার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে ।
(৬) আকস্মিক বন্যাঃ পাহাড়ি ঢলের কারণে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিশেষত মেঘনা অববাহিকায় প্রতিবছর আকস্মিক বন্যা দেখা যায়। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রায় ৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রায় ১ হাজার ৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা এ ধরনের আকস্মিক বন্যার শিকার।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের পরিমাণ আরো বেড়ে যাচ্ছে। ফলে আকস্মিক বন্যার পৌনঃপুনিকতা, ক্ষতির পরিমাণ ও তীব্রতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষত সিরাজগঞ্জ ও এর আশপাশের এলাকাসমূহে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
(৭) নদী ভাঙনঃ বাংলাদেশে সমুদ্র উপকূল বরাবর রয়েছে গঙ্গা ও মেঘনা অববাহিকায় অবস্থিত অসংখ্য প্রশস্ত জোয়ার ভাটা সমভূমি এবং নদী মোহনায় রয়েছে বদ্বীপ। নদীসঙ্গমে অবস্থিত এসব বদ্বীপ ও সমুদ্র তটরেখা বরাবর ভূখণ্ড প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। কিন্তু এ পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্যের মাঝে এক বিশেষ ভারসাম্য বজায় থাকে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে নদী ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে মেঘনা ও পদ্মার তীরবর্তী এলাকাসমূহে নদী-ভাঙনের ফলে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে।
(৮) খরাঃ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বর্ষাকালে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত ও পানির অভাবে কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে এবং ফসল উৎপাদনও ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। শীতকালেও এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাষ্পীভবনের হার বেশি। এর ফলে মাটির আর্দ্রতা হ্রাস পায় এবং কৃষিকাজের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে খরার প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বর্তমানের মাঝারি ধরনের খরা উপদ্রুত এলাকা মারাত্মক খরা উপদ্রুত এলাকায় পরিণত হবে।
(৯) সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসঃ বাংলাদেশে প্রতিবছর মে-জুন মাসে যে সামুদ্রিক ঝড় হয় তাতে উপকূলীয় জেলাসমূহে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। 'সিডর' বাংলাদেশে যে ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন রেখে গেছে তা বর্ণনাতীত।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে এটা বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের আঘাত। মহাসেন, সিডর, সুনামি, সাইক্লোনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মূলত জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনেরই ফলাফল। মানব সৃষ্ট
দূষণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের যে ধারা সৃষ্টি হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য তা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
(১০) বিপন্ন জনগোষ্ঠীঃ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কোনো মাঝারি ধরনের প্লাবনে দেশের ৬৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে এবং প্লাবন এলাকার পরিধি ক্রমেই বাড়তে থাকবে। ফলে বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়বে।
(১১) অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতিঃ ১৯৯০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট বস্তুগত সম্পদের পরিমাণ ১৮০০০ বিলিয়ন টাকা। এর মধ্যে ভৌত অবকাঠামো রয়েছে ২৮০ বিলিয়ন টাকা মূল্যের। জলবায়ু পরিবর্তন হেতু বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে প্লাবনের তীব্রতা যেমন বাড়ছে তেমনি অবকাঠামোগত IPCC-এর সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে প্লাবনজনিত কারণে বস্তুগত সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ২৪২ মিলিয়ন টাকা।
(১২) পরিবেশ বিপর্যয়ঃ বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় প্রাকৃতিক সম্পন্ন অত্যন্ত অপ্রতুল। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ অশনিসংকেত। জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন সম্পদের অপ্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ দ্রুত বিনষ্ট হওয়ার পথে। ইতোমধ্যে দেশের বৃহৎ বনভূমি সুন্দরবন ও হাওর অঞ্চলের পরিবেশীয় ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশর গৃহীত পদক্ষেপঃ

ভৌগোলিক অবস্থান এবং আবহাওয়াগত কারণে বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ এক জনপদ। বিগত কয়েক দশকের জলবায়ু পরিবর্তন দুর্যোগের এ ঝুঁকিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ১৯৯০-২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগে মোট ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে ২,১৮৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশের জিডিপি'র প্রায় ১.৮ শতাংশ। একারণে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংরক্ষণ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে বাংলাদেশ বেশ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। নিচে জলবায়ু পরিবর্তনের বেশি ক্ষতিগ্রস্থ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ আলোচনা করা হলো :
(১) জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডঃ বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলার লক্ষ্যে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত নীতি কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan-BCCSAP, 2009) প্রণয়ন করেছে। এ কৌশলপত্র বাস্তবায়নের জন্য নিজস্ব তহবিলে গঠন করা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড। ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফাণ্ড আইন ২০১০ প্রবর্তন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ২০০৯-১০ হতে ২০১২-১৩ অর্থবছরের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডে সর্বমোট ২৩৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করেছে। ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ পর্যন্ত এ ফান্ডের আওতায় ১৯৪টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া উন্নয়ন সহযোগী দেশসমূহের সহায়তায় বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্স ফান্ড (Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan-BCCSAP) গঠন করা হয়েছে। বর্তমানে এ ফাণ্ডে প্রাপ্ত সহায়তার অঙ্ক ১৮৯.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
(২) বনায়নের উপর গুরুত্বারোপঃ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকার বনায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। বাংলাদেশের নেয়া বিভিন্ন কার্যক্রমের কারণে বিগত কয়েক বছরের মধ্যে দেশে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ ৭-৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৭.০৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এ কার্যক্রম আরো সামনে এগিয়ে নিতে বদ্ধ পরিকর।
(৩) শিল্প দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কার্যক্রমঃ শিল্প বর্জ্য ও শহরের পয়ঃপ্রণালী হতে সৃষ্ট বর্জ্যের কারণে জলজ পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। ঢাকা শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর পানিতে দূষণের মাত্রা এত বেশি যে অনেক নদীতে কোন জলজ প্রাণী পর্যন্ত বাঁচতে পারে না। বাংলাদেশ এ নদীগুলোকে দূষণ হতে রক্ষার জন্য বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদী-কে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে।

পরিবেশ সংরক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নের জন্য প্রণয়ন করেছে খসড়া নির্দেশিকা। বাংলাদেশ সরকার তরল বর্জ্য নির্গমণকারী সকল কলকারখানায় বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। এর ফলে ইতোমধ্যে ৩৮১টি কলকারখানায় ইটিপি স্থাপিত হয়েছে এবং ৪২টি ইটিপি নির্মাণাধীন আছে। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকার বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণ রোধে রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত ট্যানারী শিল্পসমূহ সাভারে অবস্থিত ঢাকা চামড়া শিল্প নগরীতে স্থানান্তর করার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। সেখানে কিছু জটিলতা থাকলেও যার সুরাহা করেছে সরকার।

স্থানান্তরের জন্য কোম্পানিগুলোকে এখন চূড়ান্ত নোটিশ দেয়া হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে আগামী অর্থবছরের মধ্যে চামড়া শিল্পনগরীতে ইটিপি স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হবে। সর্বোপরি শিল্প ইউনিটে ইটিপি স্থাপনসহ অন্যান্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে গঠন করা হয়েছে ২০০ কোটি টাকার তহবিল।
(৪) জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণঃ জীববৈচিত্র্য দেশের প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষার এক অমূল্য সম্প সরকার দেশের মূল্যবান জীবসম্পদ সংরক্ষণে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা, ২০২০ এবং জাতীয় জৈব নিরাপত্তা কাঠামো প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। জাতিসংঘ জীববৈচিত্র্য সনদের আওতায় গৃহীত কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১-২০২০ এর আলোকে বাংলাদেশের জাতীয় জীববৈচিত্র্য কর্মকৌশল (National Biodiversity Strategy & Action Plan) হালনাগাদ করা হচ্ছে।
(৫) উপকূলীয় ও জলাভুমির জীববৈচিত্র রক্ষণঃ উপকূল এবং জলাভূমির জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে কক্সবাজার এলাকায় প্রায় ৬৫০ হেক্টর জলজ বন হাকালুকি হাওর এলাকায় প্রায় ৮৬০ হেক্টর জলজ বন সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ দুটো স্থানের পাশাপাশি সেন্টমার্টিনস দ্বীপ ও টাংগুয়ার হাওরে চলছে জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের কার্যক্রম।
(৬) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাঃ বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে একটি আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা, ২০১১' জারি করা হয়েছে, অনুমোদন করা হয়েছে 'জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ২০১০-২০১৫'। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির আওতায় ৪৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবক গড়ে তোলা হয়েছে।

সরকারের অর্থায়নে বন্যাপ্রবণ ও নদীভাঙ্গন এলাকায় ৭৪টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র এবং উপকূলীয় এলাকায় ১০০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। এর পাশাপাশি ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবেলায় ইতোমধ্যে ৬৯ কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। ভূমিকম্প ঝুঁকি মানচিত্র তৈরি করা, দুর্যোগ পরবর্তী অবসস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণের জন্য কন্টিনজেন্সি প্লান তৈরি, ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নির্মানের কারিগরি তথ্য সন্নিবেশিত করে বিল্ডিং কোড (Building Code) প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে।

উপসংহারঃ

একবিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে মানবজাতি যখন সভ্যতার চরম শিখরে, ঠিক তখনই এ -মানবজাতি তার পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে চরম বিপর্যয়ের দিকে। মানুষ তার প্রয়োজনে একদিকে যেমন পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করছে অপরদিকে পরিবেশকে করে তুলছে বিষাক্ত। পরিবেশ দূষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং পরিবেশের ভারসাম্য দ্রুত বিনষ্ট হচ্ছে। এ বিশ্ব আমাদেরই, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাই এ ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। আর এজন্য জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url