বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাস-বাংলাদেশের সংবিধানের ইতিহাস
সংবিধান হলো কোন রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার মৌলিক দলিল যাতে, স্বায়ত্তশাসিত কোন
রাজনৈতিক সত্তার দায়িত্ব এবং কর্তব্য নির্ধারণের মৌলিক নিয়ম ও সূত্রসমূহ
লিপিবদ্ধ থাকে। কোন একটি দেশের রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য সরকার কিভাবে নির্বাচিত
হবে, শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ গঠনের পদ্ধতি এবং এদের ক্ষমতা ও
কর্তব্য কেমন হবে, সরকারের সাথে জনগণের সম্পর্ক কেমন হবে এই সকল বিষয় সংবিধানে
লিপিবদ্ধ থাকে।
আলোচ্য বিষয়ঃ- বাংলাদেশের সংবিধান-বাংলাদেশের সংবিধানের ইতিহাস
সংবিধানের ধরণ
সংবিধান দুই ধরনের হতে পারে। যথা-
(১) লিখিত।
(২) অলিখিত।
অলিখিত সংবিধান
যে সংবিধনের কিছু অংশ লিখিত, কিছু অংশ প্রথা দ্বারা প্রচলিত হয় এবং যা একটি
নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্বারা পাশ হয় না তাকে অলিখিত সংবিধান বলে। যেমন-
গ্ৰেট ব্রিটেনের সংবিধান,সৌদি আরবের সংবিধান, ভারতের সংবিধান,মিশরের
সংবিধান,পাকিস্তানের সংবিধান,প্যালেস্টাইনের সংবিধান,ব্রাজিলের
সংবিধান,আর্জেন্টিনার সংবিধান,ইসরাইলের সংবিধান,লেবাননের সংবিধান,ইরানের
সংবিধান,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান,জাপানের সংবিধান,চীনের সংবিধান,সংযুক্ত
আরব আমিরাতের সংবিধান।
বাংলাদেশের সংবিধান
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন হলো সংবিধান। বাংলাদেশের সংবিধান
দুষ্পরিবর্তনীয় অর্থাৎ পরিবর্তন করা সহজ নয়। বাংলাদেশের সংবিধানে ১১ টি
(Chapter) ভাগ বা অধ্যায় এবং ১৫৩ টি (Articles) অনুচ্ছেদ এবং ৪টি মূলনীতি
রয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (Preamble) প্রস্তাবনা দিয়ে শুরু
হয়েছে এবং ৭ টি তফসিল (Schedules) দিয়ে শেষ হয়েছে। সংবিধান হলো রাষ্ট্র
পরিচালনার জন্য লিখিত ও অলিখিত বিধি-বিধানের সমষ্টি। বিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটল
এর মতে - “সংবিধান হলো— রাষ্ট্র কর্তৃক পছন্দকৃত জীবন বিধান'।
(Preamble) প্রস্তাবনা
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা হলো-
[বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে) পরম করুনাময়
সৃষ্টিকর্তার নামে।]
বাংলাদেশের সংবিধানের ইতিহাস
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটির সদস্য ছিলেন ৩৪ জন। এই সংবিধান
রচনা কমিটির প্রধান ছিলেন ড. কামাল হোসেন। একমাত্র মহিলা সদস্য ছিলেন বেগম
রাজিয়া বানু। সংবিধান রচনা কমিটির একমাত্র বিরোধীদলীয় সদস্য ছিলেন - সুরঞ্জিত
সেন গুপ্ত।
১২ অক্টোবর, ১৯৭২ সালে গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘খসড়া সংবিধান’ উত্থাপন
করেছিলেন ড. কামাল হোসেন। গণপরিষদ কর্তৃক খসড়া সংবিধানটি ৪ নভেম্বর, ১৯৭২ সালে
গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২ সালে কার্যকর করা হয়।
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত হল সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের দুটি বিভাগ রয়েছে।
(১) আপিল বিভাগ
(২) হাইকোর্ট বিভাগ।
বাংলাদেশে এককেন্দ্রিক সরকার পদ্ধতি চালু রয়েছে। এবং দেশের সর্বোচ্চ আইন
প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ হলো শাসন বিভাগ। সংবিধান প্রণয়নের জন্য রাষ্ট্রপতি ২৩
মার্চ, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ জারি করেন। গণপরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা
ছিল - ৪০৩ জন। ১০ এপ্রিল, ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতি গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন আহ্বান
করেন। গণপরিষদের স্পিকারের দায়িত্ব পালনে ছিলেন— শাহ আব্দুল হামিদ। এবং
গণপরিষদের ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্বে ছিলেন— মোহাম্মদ উল্লাহ। প্রতি বছর ৪
নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান দিবস হিসেবে পালিত হয়।
হস্তলিখিত বাংলাদেশের সংবিধানের লেখক ছিলেন — শিল্পী আব্দুর রউফ। হস্তলিখিত
সংবিধানে কারুকাজ বা প্রচ্ছদ, ডিজাইন করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।
বাংলাদেশের হস্তরেখিত সংবিধানে মোট— ৯৩ টি পাতা রয়েছে। হস্তলিখিত সংবিধানে
গণপরিষদের মোট ৩০৯ জন সদস্য স্বাক্ষর করেছিলেন। একমাত্র সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত
হস্তলিখিত সংবিধানে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত ছিলেন। সংবিধান গৃহীত হওয়ার সময়
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সংবিধানের প্রকার
সংবিধান প্রধানত চার প্রকারে হয়ে থাকে। যথা- লিখিত, অলিখিত, সুপরিবর্তনীয় ও
দুষ্পরিবর্তনীয়। বাংলাদেশের সংবিধান লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয়। বিশ্বে বৃটেন,
স্পেন, সৌদি আরব ও নিউজিল্যান্ড এর কোন লিখিত সংবিধান নেই। পৃথিবীর সবচাইতে বড়
সংবিধান হলো ভারতের। এবং সবচাইতে ছোট সংবিধান হল যুক্তরাষ্ট্রের।
সংবিধানের প্রস্তাবনা ও বৈশিষ্ট্য
- বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ (People's Republic of Bangladesh).
- বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন— সংবিধান।
- বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনার মূল বিষয়— ‘বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।’
- বাংলাদেশের সংবিধান দুষ্পরিবর্তন এবং বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনীর জন্য সংসদের দুই- তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হয়।
- মূলনীতিসমূহ— জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
- সংবিধানে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
- বাংলাদেশের সরকার পদ্ধতি — সংসদীয় ও এককেন্দ্রীক ।
- সংবিধান বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন।
- সংবিধানে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার প্রদান করা হয়।
- বাংলাদেশ সংবিধানে তিন ধরনের মালিকানার কথা উল্লেখ আছে— রাষ্ট্রীয়, সমবায় ও ব্যক্তিগত।
- বাংলাদেশের আইনসভা এক কক্ষ বিশিষ্ট।
- জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা — ৩৫০ (সংরক্ষিত ৫০)।
- সংবিধান অনুসারে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং রাষ্ট্র ভাষা- বাংলা ।
- বাংলাদেশ সংবিধানে স্বাধীন বিচার বিভাগের পাশাপাশি উল্লেখ আছে— প্রশাসনিক ট্রাইবুনালের।
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহ
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সংবিধানের ২য় ভাগে উল্লেখ আছে।
অনুচ্ছেদ ৮ অনুযায়ী- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাসহ এই
সকল মূলনীতি হতে উদ্ভূত সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গণ্য।
অনুচ্ছেদ-৯ : জাতীয়তাবাদ
অনুচ্ছেদ-১০: সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি।
অনুচ্ছেদ-১১ : গণতন্ত্র ও মানবাধিকার।
অনুচ্ছেদ-১২: ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা।
অনুচ্ছেদ-১৩ মালিকানা নীতি ।
অনুচ্ছেদ-১৪: কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি। অনুচ্ছেদ-১৫ মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা।
অনুচ্ছেদ-১৬: গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব 1
অনুচ্ছেদ-১৭ : অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা
অনুচ্ছেদ-১৮: জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা।
অনুচ্ছেদ-১৮(ক) : পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন।
অনুচ্ছেদ-১৯: সুযোগের সমতা।
অনুচ্ছেদ-২০: অধিকার ও কর্তব্যরূপে কর্ম ।
অনুচ্ছেদ-২১ : নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য।
অনুচ্ছেদ-২২ নির্বাহী বিভাগ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ।
অনুচ্ছেদ-২৩ : জাতীয় সংস্কৃতি।
অনুচ্ছেদ-২৩(ক) : উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি।
অনুচ্ছেদ-২৪ : জাতীয় স্মৃতি নিদর্শন প্রভৃতি।
অনুচ্ছেদ-২৫ : আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন।
মৌলিক অধিকার
সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকারে উল্লেখ রয়েছে।
অনুচ্ছেদ-২৬ : মৌলিক অধিকারের সহিত অসমাঞ্জস্য আইন বাতিল ।
অনুচ্ছেদ-২৭ : আইনের দৃষ্টিতে সমতা।
অনুচ্ছেদ-২৮ : ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য রোধ ।
অনুচ্ছেদ-২৯ : সরকারি নিয়োগ লাভের সুযোগের সমতা।
অনুচ্ছেদ-৩০ : বিদেশী খেতাব প্রভৃতি গ্রহণ নিষিদ্ধকরণ।
অনুচ্ছেদ-৩১ : আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার।
অনুচ্ছেদ-৩২ : জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার ও সংরক্ষণ ।
অনুচ্ছেদ-৩৩ : গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ।
অনুচ্ছেদ-৩৪ : জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ।
অনুচ্ছেদ-৩৫ : বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে রক্ষণ ।
অনুচ্ছেদ-৩৬: চলাফেরার স্বাধীনতা।
অনুচ্ছেদ-৩৭ : সমাবেশের স্বাধীনতা।
অনুচ্ছেদ-৩৮ : সংগঠনের স্বাধীনতা।
অনুচ্ছেদ-৩৯ : চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা ।
অনুচ্ছেদ-৪০ : পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা।
অনুচ্ছেদ-৪১ : ধর্মীয় স্বাধীনতা।
অনুচ্ছেদ-৪২ : সম্পত্তির অধিকার।
অনুচ্ছেদ-৪৩ : গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ।
অনুচ্ছেদ-৪৪: মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ।
অনুচ্ছেদ-৪৫ : শৃঙ্খলামূলক আইনের ক্ষেত্রে অধিকারের পরিবর্তন।
অনুচ্ছেদ-৪৬ : দায়মুক্তি বিধানের ক্ষমতা ।
অনুচ্ছেদ-৪৭ : কতিপয় আইনের হেফাজত।
সচরাচর জিজ্ঞাসা
বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম কি?
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি কয়টি?
বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি হলো ৪ টি।
বাংলাদেশের সংবিধানের মোট ভাগ কয়টি?
১১ টি।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ কয়টি?
১৫৩ টি।
সংবিধান রচনা কমিটির সদস্য কতজন?
৩৪ জন।
সংবিধান রচনা কমিটির একমাত্র মহিলা সদস্য কে?
বেগম রাজিয়া বানু।
বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান গণপরিষদে কত তারিখে উত্থাপিত হয়?
১২ই অক্টোবর, ১৯৭২ সালে গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে।
বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান গণপরিষদে কত তারিখে গৃহীত হয়?
৪ নভেম্বর, ১৯৭২ সালে।
বাংলাদেশের সংবিধান কত তারিখে কার্যকর হয়?
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২ সালে।
হস্তলিখিত সংবিধানের মূল লেখক কে?
হস্তলিখিত সংবিধানের মূল লেখক ছিলেন শিল্পী আব্দুর রউফ।
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url