পরিবার পরিকল্পনা কি-পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গুলো কি কি
পরিবার পরিকল্পনা হলো একটি দম্পত্তির সঠিক সময়ে সন্তান নেয়ার পরিকল্পনা এবং জন্ম
নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য পদ্ধতির যথাযত প্রয়োগ নিশ্চিত করা। অন্যান্য পদ্ধতি যেমন-
যৌন শিক্ষা, যৌনবাহিত সংক্রামক রোগসমুহের নির্গমন প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি।
পরিবার পরিকল্পনা বলতে শুধুমাত্র জন্ম নিয়ন্ত্রণ করাকে বোঝায় না। পরিবার
পরিকল্পনার পরিধি আরও বিশদ। সাধারণত সে সকল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পরিবার
পরিকল্পনা করা হয় যে দম্পত্তি তাদের সন্তান সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত রাখতে চান এবং
তাদের প্রত্যাশিত যে কোন সময়ে গর্ভধারণ করতে চান।
সূচিপত্রঃ- পরিবার পরিকল্পনা কি-পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গুলো কি
কি
পরিবার পরিকল্পনা একটি জীবন ধারনের পদ্ধতি যা, একজন ব্যক্তি বা দম্পত্তি,
স্বেচ্ছায় গ্রহন করবে সবকিছু নিজেরা জেনে, যাতে নিজের পরিবারের লোক সংখ্যা নিজের
ইচ্ছানুযায়ী সীমাবদ্ধ রাখা যায় এবং যা সমাজজীবন ও পরিবারের উন্নয়নে সহায়ক
হবে।
পরিবার পরিকল্পনা সেবা বলতে শিক্ষাগত, ব্যাপক স্বাস্থ্য ও সামাজিক কমসূচীকে
বোঝায় যার মাধ্যমে প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র ব্যক্তি তাদের সন্তান সংখ্যা ও দুই
সন্তানের ব্যবধান সম্পর্কে স্বাধীনভাবে সিধান্ত নেবার যোগ্যতা অর্জন করে।
পরিবার পরিকল্পনা উদ্যেশ্য
১। ইচ্ছানুযায়ী বাচ্চার জন্মদান ।
২। ইচ্ছানুযায়ী বাচ্চার জন্ম এড়ানো।
৩। দুই বাচ্চার জন্মের মধ্যের সময় নিয়ন্ত্রণ ।
৪। পরিবারে বাচ্চার সংখ্যা নিরূপন ।
পরিবার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণ
আমাদের দেশে জনসংখ্যা সমস্যা একটি ভয়াবহ সমস্যা যা নিয়ন্ত্রণ করা একান্ত
প্রয়োজন। বর্তমানে আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৮% ভাগ। এই জনসংখ্যা বিষ্ফোরন
আমাদের দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করেছে। মানুষ এ
ব্যাপারে এখনই সচেতন না হলে দেশের অবস্থা হবে শোচনীয়। সুতরাং স্বাস্থ্যকর্মী ও
পল্লী চিকিৎসকদের অন্যতম গুরুদায়িত্ব হচ্ছে পল্লী এলাকার কুসংস্কারচ্ছন্ন জনগণকে
বোঝানো ।
উচ্চ শিশু মৃত্যু হারঃ অশিক্ষিত মানুষের ধারনা, বেশী বাচ্চা হলে বৃদ্ধ
বয়সে তাদের মধ্যে যারা বেচে থাকবে তারা সাহায্য করবে। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা
ভুল। কেননা কম বাচ্চাকে ভালভাবে লালন পালন করলে, চিকিৎসা ও শিক্ষা দিলে তারা
পিতা-মাতা ও সমাজের জন্য উপকারী হয়।
দারিদ্রতাঃ শিশু বেশী থাকলে গৃহস্থালী কাজে বেশী শ্রম পাওয়া যাবে-এই
ধারনা থেকে বাচ্চা জন্ম দেবার প্রবণতা বেশী। এছাড়া পয়সা খরচ করে জন্ম
নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ক্রয়ের ব্যাপারে অনীহা।
ধর্মীয় গোড়ামী
অজ্ঞতা ও অশিক্ষা।
কুসংস্কার।
বিনোদনের অভাব ইত্যাদি
জন্ম নিয়ন্ত্রনের পদ্ধতি
জন্ম নিয়ন্ত্রনের বহুবিধ পদ্ধতি প্রচলিত আছে এর মধ্যে প্রাকৃতিক পদ্ধতি হাজার
বছর ধরে প্রচলিত।
পদ্ধতিসমূহঃ
স্থায়ী পদ্ধতি
(১) পুরুষদের ভ্যাসেকটমী
(২) মেয়েদের লাইগেশন।
এই দুইটির মধ্যে ভ্যাসেকটমী সুবিধাজনক। কেননা এতে
(ক) রোগীকে হাসপাতালে থাকতে হয় না।
(খ) ২ দিনের মধ্যেই সে স্বাভাবিক কাজ কর্ম শুরু করতে পারে।
(গ) সহজ অপারেশন, জটিলতা কম।
(ঘ) যৌন ক্ষমতা কমে যায় না।
কোন দম্পত্তিরা স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করবে ?
পরিবার সম্পূর্ণ অর্থাৎ দম্পত্তির দুইজন সন্তান থাকবে।
ছোট বাচ্চার বয়স কম পক্ষে পাচ।
উভয় বাচ্চার কোন বড় ধরনের রোগ নাই এবং ই.পি.আই'র টিকা দেয়া সম্পূর্ণ।
দম্পত্তির উভয়ের স্বেচ্ছা সম্মতিতে পদ্ধতি গ্রহণ ।
স্ত্রীর বয়স ২০-এর উর্ধে ও ৪০ এর নীচে, স্বামীর বয়স ৩০-এর উর্ধে ও ৫০ এর
নীচে নয়।
লাইগেশনের অসুবিধাসমূহ
(১) স্থায়ী পদ্ধতি কোন কারণে বাচ্চারা মৃত্যু বরণ করলে স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্ত
হবার আশংকা।
(২) অপারেশনে জটিলতার সম্ভাবনা বেশী।
(৩) ১ সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হয়।
স্থায়ী পদ্ধতির সুবিধাঃ
(১) একবার মাত্র এ পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয়।
(২) এটা ১০০ ভাগ কার্যকরী।
(৩) বিনামূল্যে গ্রহণ করা যায়
(৪) পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কম হয় ।
স্থায়ী পদ্ধতির অসুবিধাঃ
(১) সবাই সব বয়সে গ্রহণ করতে পারে না।
(২) অপরিবর্তনীয় পদ্ধতি অর্থাৎ একবার এই পদ্ধতি গ্রহণ করলে সন্তান জন্মদেবার
ক্ষমতা ফিরে পাওয়া খুবই জটিল ও ব্যয় বহুল, কোন কোন ক্ষেত্রে অসম্ভব।
(৩) অপারেশন এর পর ইনফেকশন ও অন্যান্য জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে
(৪) মানসিক ও সামাজিক সমস্যা হতে পারে ।
(৫) ডায়েবেটিস, হার্টের রোগী, উচ্চ রক্তচাপে রোগীর জন্য এটা ঝুকিপূর্ণ পদ্ধতি ।
অস্থায়ী পদ্ধতিসমূহঃ
(ক) নিরোধ পদ্ধতিঃ
(১) কনডম
(২) ফোম টবলেট
(খ) মেকানিকেল বা যান্ত্রিক পদ্ধতিঃ
(১) ইন্ট্রা ইউটেরাইন কপার ডিভাইস, যেমন-কপারটি।
(গ) হরমোন পদ্ধতিঃ
(১) খাবার বড়ি
(২) ইনজেকশন
(৩) চামড়ার নীচে ইমপ্লান্ট- নরপ্লান্ট
(গ) প্রাকৃতিক পদ্ধতিঃ
(১) সেফ পিরিয়ড : মাসিকের পূর্বে ১০ দিন ও পরবর্তী ৫ দিন। তবে এটা খুব একটা
কার্যকরী পদ্ধতি নয়।
(২) সঙ্গমের সময় বাইরে স্খলন ।
(৩) বাচ্চাকে বুকের দুধ প্রদান ইত্যাদি।
আমাদের দেশে তিন/ চারটি পদ্ধতি খুবই জনপ্রিয়। এ পদ্ধতিগুলো নিয়ে আলোচনা করা
হলো। এদের মধ্যে ইনজেকশন এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া খুবই বিপদজনক বিধায় গ্রহণ করা
উচিত না।
বিদেশে ইনজেকশন নিষিদ্ধ। বরং কপার টির ব্যবহার সহজ, নিরাপদ এবং দীর্ঘস্থায়ী।
কপারটি যে কোন পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিক বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পাওয়া যায়
বিনামূল্যে। এই পদ্ধতির সুবিধা বেশী। অসুবিধা হলে ডাক্তারের কাছে গেলে সহজেই খুলে
দিতে পারবে। সুতরাং পল্লীর জনগণকে এ পদ্ধতির ব্যাপারে জানানো উচিত।
খাবার বড়ি (Oral Pill)
আমাদের দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি। বিভিন্ন খাবার বড়ি সহজে পাওয়া যায়।
সুবিধাঃ
(১) ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রে সফল।
(২) সহজে বন্ধ করা যায়।
(৩) সঙ্গমে বিরতি দিতে হয় না।
(৪) সুলভ ও সহজলভ্য ।
(৫) পরবর্তী জন্মদানে অসুবিধা হয় না।
অসুবিধাঃ
(১) সব মহিলারা খেতে পারেন না। যেমন-উচ্চ রক্তচাপ, লিভারের রোগ, ক্যানসারের
রোগীরা ইত্যাদি।
(২) প্রতিদিন খেতে হয়। পর পর ২ দিন বাদ গেলে ঐ মাসে অন্য পদ্ধতি নিতে হয়।
(৩) পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বেশী : যেমন-বমি বমি ভাব, মাথা ঘুরানো, স্তন টনটন করা,
মাথা ব্যথা, অবসন্ন ভাব ইত্যাদি
(৪) দীর্ঘ ব্যবহারে রোগ হতে পারে। তাই এক নাগাড়ে ৩ বছরের বেশী ব্যবহার করা ঠিক
না ।
কনডম (Condom)
খুবই সহজলভ্য এবং সস্তা। রাবারে তৈরী। সঙ্গমের পূর্বে উত্থিত লিঙ্গে পড়তে হয়।
নিচে কনডম ব্যবহারের সুবিধা, অসুবিধা আলোচনা করা হলো।
সুবিধাঃ
(১) সহজে ব্যবহার্য, সস্তা এবং কার্যকরী ৮৯%।
(২) মাসিক চক্রের যে কোন সময় ব্যবহার করা যায় বলে নব দম্পতিদের জন্য আদর্শ।
(৩) কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নাই।
(৪) পরামর্শ বা ব্যবহারের জন্য ডাক্তারের নিকট যাওয়ার প্রয়োজন নাই।
(৫) যৌনরোগ থেকে রক্ষা করে।
(৬) বীর্য পরীক্ষার জন্য, বীর্য সংগ্রহের সহজ একটি পদ্ধতি ।
অসুবিধাঃ
(১) ১০০% ভাগ কার্যকরী নয়।
(২) ছিড়ে বা ফেটে যেতে পারে।
(৩) অনেক মহিলা পূৰ্ণ যৌনতৃপ্তি পায় না ।
(৪) সঙ্গমের চূড়ান্ত সময়ে পড়তে হয়, বলে বিরক্তি উৎপাদন করে।
(৫) অনেকের রাবারে এলার্জি হতে পারে।
ইনজেকশন (Injection)
আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে মহিলাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। আমাদের দেশে যেটি
পাওয়া যায়, তার নাম Inj. Depo. Provera ইত্যাদি। এতে এক ধরনের হরমোন
থাকে।
এক ধরনের পেচানো তার ডাক্তাররা যোনী পথের মাধ্যমে এটা জরায়ুতে পড়িয়ে দেন।
বিভিন্ন ধরনের কপারটি পাওয়া যায়। ৩ হতে ৭ বৎসর মেয়াদী হয়। বর্তমানে এরও
জনপ্রিয়তা বাড়ছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে বিনামূল্যে পাওয়া যায়।
সুবিধাঃ
(১) দীর্ঘস্থায়ী
(২) বিনামূল্যে পাওয়া যায় ।
(৩) প্রায় ১০০ ভাগ কার্যকরী।
(৪) যে কোন সময়ে খুলে ফেলা যায়
অসুবিধাঃ
(১) পড়ানো ও খোলার জন্য ডাক্তার / নার্সের কাছে যেতে হয়।
(২) সবাইকে সুট করে না। অনেকের বিভিন্ন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় ।
(৩) ঠিকমত না পড়ালে ছিদ্র হয়ে সমস্যা হতে পারে।
সন্তান সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে সময়, সামাজিক,অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত নিরাপত্তার
প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়। পরিবার পরিকল্পনার গ্রহণ করার মাধ্যমে এসকল সম্পদের
যতার্থ্য ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশের তথা সারা বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধি
পৃথিবীকে বসবাসের অনুপোযোগী এবং সমস্যা সংকূল করে তুলছে। তাই সংখ্যা বৃদ্ধি রোধ
অথবা পরিমিত সন্তান জন্ম দান করে পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রাখতে পরিবার পরিকল্পনা
আবশ্যক।
আপনার জিজ্ঞাসা
পরিবার পরিকল্পনা কি?
পরিবার পরিকল্পনা হলো একটি দম্পত্তির সঠিক সময়ে সন্তান নেয়ার পরিকল্পনা এবং
জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য পদ্ধতির যথাযত প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
পরিবার পরিকল্পনার মূল কথা কি?
পরিবার পরিকল্পনা হলো একটি জীবন ধারনের পদ্ধতি যা, একজন ব্যক্তি বা দম্পত্তি,
স্বেচ্ছায় গ্রহন করবে সবকিছু নিজেরা জেনে, যাতে নিজের পরিবারের লোক সংখ্যা
নিজের ইচ্ছানুযায়ী সীমাবদ্ধ রাখা যায় এবং যা সমাজজীবন ও পরিবারের উন্নয়নে
সহায়ক হবে।
পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গুলো কি কি?
স্থায়ী পদ্ধতিঃ (১) পুরুষদের ভ্যাসেকটমী (২) মেয়েদের লাইগেশন। অস্থায়ী
পদ্ধতিসমূহঃ (ক) নিরোধ পদ্ধতিঃ (১) কনডম (২) ফোম টবলেট (খ) মেকানিকেল বা
যান্ত্রিক পদ্ধতিঃ (১) ইন্ট্রা ইউটেরাইন কপার ডিভাইস, যেমন-কপারটি। (গ) হরমোন
পদ্ধতিঃ (১) খাবার বড়ি (২) ইনজেকশন (৩) চামড়ার নীচে ইমপ্লান্ট : নরপ্লান্ট
(গ) প্রাকৃতিক পদ্ধতিঃ (১) সেফ পিরিয়ড : মাসিকের পূর্বে ১০ দিন ও পরবর্তী ৫
দিন। তবে এটা খুব একটা কার্যকরী পদ্ধতি নয়। (২) সঙ্গমের সময় বাইরে স্খলন ।
(৩) বাচ্চাকে বুকের দুধ প্রদান ইত্যাদি।
পরিবার পরিকল্পনা স্লোগান কি?
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের চালানো বর্তমান প্রচারণার স্লোগান-'দুইটি
সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়।”
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url