পরিবেশ দূষণের কারণ ও ফলাফল-বিশ্ব পরিবেশগত সমস্যা

সুস্থ জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর নির্মল পরিবেশ। পরিবেশের ভালোমন্দ দুটি দিকই মানুষসহ সমগ্র জীবজগতে অস্তিত্বের জন্য গুরুত্ব বহন করে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তন জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।
পরিবেশ দূষণের কারণ ও ফলাফল-বিশ্ব পরিবেশগত সমস্যা
পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলে চলমান উন্নয়ন প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়।
প্রশ্নঃ বিশ্ব পরিবেশগত সমস্যার স্বরূপ আলোচনা করুন। এগুলো মোকাবিলার জন্য কি কি আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে? (২৫তম বিসিএস)
অথবা, বিশ্বের পরিবেশ দূষণের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করুন। (২৩-তম বিসিএস)

সূচিপত্রঃ- পরিবেশ দূষণের কারণ ও ফলাফল-বিশ্ব পরিবেশগত সমস্যা

ভুমিকাঃ

পৃথিবীর পরিবেশ আজ শিল্পায়ন, জনসংখ্যা ও যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ইত্যাদি কারণে বিপন্ন। বিপন্ন পরিবেশকে মোকাবিলায় আন্তর্জাতিকভাবে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্মেলন, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও স্মারক লিপি স্বাক্ষর, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ফান্ড গঠনসহ বহুমুখী কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। তবুও রক্ষা করা যাচ্ছে না বিশ্বকে পরিবেশ দূষণের হাত থেকে।

পরিবেশ সমস্যাবিষয়ক ধারণাঃ

পরিবেশ সমস্যা বলতে বোঝায় প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতাকে, যা পরিবেশকে হুমকির সম্মুখীন করে, পৃথিবীকে মনুষ্য বাসের অযোগ্য করে তোলে।
সৃষ্টি করে নানাবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। প্রাণীর জীবনধারণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। পরিবেশ সমস্যা বলতে বোঝায় বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, মাটি দূষণ, খাদ্য দূষণ, গ্রিন হাউস গ্যাস ও তার প্রভাব।

বিশ্ব পরিবেশগত সমস্যার স্বরূপঃ

বিশ্ব পরিবেশগত সমস্যার স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে কতকগুলো সুনির্দিষ্ট বিষয় প্রতিভাত হয়। নিচে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
(১) শিল্পবিপ্লবঃ পরিবেশ সমস্যা নতুন কিছু নয়। আদিম যুগে পৃথিবীতে যখন থেকে আগুনের ব্যবহার
শুরু হয় তখন থেকেই প্রাণ প্রদায়ী অক্সিজেনের ধ্বংস শুরু হয়। আর এ অক্সিজেনের ধ্বংসের সাথে সাথে কেবল পরিবেশের ভারসাম্যই নষ্ট হয়নি বরং ধোঁয়া ও ভস্মকণায় পরিবেশকে করে তুলেছে কলুষিত। তবে এ সমস্যা তীব্র আকারে দেখা দিয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্পবিপ্লবের সূচনা থেকে। শিল্পের সমূহ বিকাশ বিশ্ব অর্থনীতিতে স্পন্দন জাগিয়েছে- এ কথা ঠিক। কিন্তু প্রত্যেকটি ক্রিয়ার অবশ্যই আছে প্রতিক্রিয়া। যন্ত্র সভ্যতার বিকাশের যে গতি তার সাথে পাল্লা দিয়ে প্রকৃতি বিরূপ হচ্ছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে এসে দেখা যায়, পরিবেশ কেবল সমস্যাই নয় বরং এটি মারাত্মক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে র‍্যাচেল কারসন-এর বই The Silent Spring' প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে পাশ্চাত্যের দেশে দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে গ্রিন হাউস প্রভাব সবার ধারণায় আসে। ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিকা সার্ভের আবহাওয়া বিজ্ঞানী ঘোষণা করেন যে, অ্যান্টার্কটিকার আকাশে ওজোনের পরিমাণ কমছে, যার ফলে ওজোন স্তর ফুটো হয়ে অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে ঢুকে পড়ছে এবং সমগ্র জীব জগতের প্রভৃত ক্ষতি করছে।
(২) জনসংখ্যা বৃদ্ধিঃ সচেতন বা অচেতন যে করেই হোক প্রাচ্য-প্রতীচ্য সবখানেই পরিবেশ বিপর্যয় মানুষকে বিরূপ স্তরে নিয়ে গেছে, করে তুলেছে উৎকণ্ঠিত। মানবসভ্যতার অন্তরায় হিসেবে পৃথিবী আজ হয়েছে বিপন্ন। আদিকালে মানুষের সংখ্যা কম ছিল। তাই তাদের নির্গত বর্জ্য পদার্থও ছিল পরিমাণে কম। এছাড়াও তখনকার মানুষের নিত্য বর্জ্য পদার্থ হয়তোবা অন্য প্রাণীর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হতো, নয়তো তা পরিবেশের অণুজীবদের দ্বারা বিনষ্ট হয়ে অণু-পরমাণুতে রূপান্তরিত হয়ে আবার পরিবেশে মিশে যেত। কিন্তু বর্তমানে তার উল্টো।
মানুষ জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে আর তৈরি হচ্ছে এমন সব কৃত্রিম পদার্থ যা কেবল পরিবেশকে বিনষ্টই করে না, এমনকি এত বিষ বা রাসায়নিক দ্রব্য পরিবেশে ঢুকছে যা পরিবেশের শোষণ প্রক্রিয়াকে ক্রমশ ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ সমস্যা সমস্যা হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। উপরন্তু তৈরি করছে নতুন জটিল সমস্যা। এভাবেই পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে মানুষের বাস অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এর জন্য দায়ী মানুষই।
(৩) সবুজ বিপ্লবঃ অধিক ফসল উৎপাদনের জন্য জমিগুলোতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ৬০-এর দশকে সবুজ বিপ্লবের নামে উন্নয়নশীল বিশ্বে এ ব্যবস্থা শুরু হয়। চাষাবাদে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলারসহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহারের কারণে কৃষিতে শ্রমের উদ্বৃত্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়। গ্রামীণ কাঠামোগত পরিবর্তনে বহুসংখ্যক লোক বেকার হয়ে পড়ায় কাজের সন্ধানে শহর এলাকায় ভিড় করে। শহরের সামগ্রিক পরিবেশের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। সবুজ বিপ্লবের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও জমির উর্বরতা হ্রাস পায়, কৃষি উপকরণের অবাধ অপরিকল্পিত ব্যবহার পরিবেশের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেখা দেয় আর্সেনিক, নানা ধরনের জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধি।
(৪) জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধিঃ সারা বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও এর চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে
কয়লা, গ্যাস, তেলের ব্যবহার শুরু হওয়ার সাথে সাথে এবং বন উজাড়ের ফলে প্রকৃতিতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়, যা পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
(৫) নগরায়ন ও ভারসাম্যহীন উন্নয়নঃ 'God made the village and Man made the city. উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রতিবছর অধিক পরিমাণে মানুষ পাড়ি জমাচ্ছে নগরে। ফলে নগরে চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগরজীবনে মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। পরিবেশের অবনতির মূলে যতটা না দায়ী প্রযুক্তির বিকাশ, তার চেয়ে অনেক দায়ী পরিবেশের ভারসাম্যের দিকে না তাকিয়ে অনেকটা বলগাছাড়া গোছের উন্নয়ন। পরিবেশগত সমস্যার কারণে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ফেব্রুয়ারি ২০০৭ পৃথিবীর বাঘা বাঘা ৬২০ জন জলবায়ু বিজ্ঞানী সতর্ক বাণী করেন যে, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ঝড়, তুফান, খরা, দাবানল,, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি বেড়ে যাবে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়বে ৩.২-৭.১ ফারেনহাইট, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে ৭-২৩ ইঞ্চি। একুশ শতকে আর্কটিক সাগরে জমে থাকা বরফ গলে যেতে পারে। ইউরোপের ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোতে বাসযোগ্য পরিবেশ নাও থাকতে পারে, আফ্রিকা ও এশিয়ার খরা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
এলনিনোর প্রভাবে সাগর-মহাসাগরে তাপমাত্রা ও বায়ুমণ্ডলে নেতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাবে। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। বন উজাড়ের ফলে আফ্রিকার মাদাগাস্কারের প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির প্রাণীর জীবন বিপন্ন হয়েছে। আশঙ্কাজনক হারে বৃক্ষ নিধনের ফলে বিশ্বের অনেক এলাকা মরুময় হয়ে যাচ্ছে। বনজ ও সামুদ্রিক প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে।

বিশ্ব পরিবেশগত সমস্যা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক পদক্ষেপঃ

জ্বালানি উন্নয়নসহ সকল ধরনের উন্নয়ন সকলের কাছে কাম্য হলেও উন্নয়নের ফলে সৃষ্ট পরিবেশগত সমস্যা অনেকের কাছে অপ্রত্যাশিত। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দশকে শুরু হওয়া শিল্পবিপ্লবের প্রায় ২০০ বছর পরে সারা বিশ্বের মানুষ সার্বিকভাবে পরিবেশগত সমস্যা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন, কনভেনশন ও প্রটোকলের মাধ্যমে, যার গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হিসেবে পরিবেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নিচে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
(১) প্রথম পরিবেশ সম্মেলনঃ ১৯৬৮ সালের ৩০ জুলাই জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (ECOSOC)-এর ৪৫তম অধিবেশনে এবং ১৯৬৮ সালের ৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৩তম অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে প্রথম পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালের ৫-১৬ জুন সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনের নাম ছিল জাতিসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলন (United Nations Conference on the Human Environment)
(২) ধরিত্রী সম্মেলনঃ প্রথম পরিবেশ সম্মেলনে দ্বিতীয় সম্মেলনের আহ্বানের প্রস্তাব গৃহীত হলেও এর অন্যতম শর্ত ছিল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা গৃহীত হবে। ১৯৮৮ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে এবং প্রথম সম্মেলনের দু'দশক পূর্তি উপলক্ষে ১৯৯২ সালের ৩-১৪ জুন ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত হয় পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক জাতিসংঘ সম্মেলন (United Nations Conference on Environment and Development), যা ধরিত্রী সম্মেলন (Earth Summit) বা রিও কনফারেন্স (Rio Conference) নামে পরিচিত।
(৩) বিশেষ পরিবেশ সম্মেলনঃ ১৯৯২ সালের ধরিত্রী সম্মেলন পর্যালোচনার লক্ষ্যে পাঁচ বছর পর জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৯৭ সালের ২৩-২৭ জুন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয় পরিবেশ বিষয়ক বিশেষ সম্মেলন। এটি ধরিত্রী সম্মেলন + ৫ (Earth Summit + 5) বা রিও +৫ (Rio + 5) নামে পরিচিত।
(৪) বিশ্ব টেকসই উন্নয়ন সম্মেলনঃ ১৯৯২ সালের ধরিত্রী সম্মেলন পর্যালোচনার লক্ষে ২০০০ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব টেকসই উন্নয়ন সম্মেলন (World Summit on Sustainable Development- WSSD) এ সম্মেলন রিও + ১০ (Rio + 10) বা ধরিত্রী সম্মেলন ১০ (Earth Summit + 10) নামে পরিচিত।
(৫) কপ (COP) সম্মেলনঃ জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘ রূপরেখা কনভেনশন (UNFCCC) ১৯৯৪ সালের ২১ মার্চ কার্যকর হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কনফারেন্সেস অব দ্য পার্টিস- কপ (Conferences of the Parties-COP) নামে পরিচিত এ সম্মেলনে UNFCCCভুক্ত দেশসমূহ অংশগ্রহণ করে। ১৯৯৫ সালের ২৮ মার্চ-৭ এপ্রিল জার্মানির বার্লিনে প্রথম এবং ২০১২ সালে ১৮তম COP অনুষ্ঠিত হয় ২৬ নভেম্বর-৮ ডিসেম্বর, কাতারের দোহায়। বিশ্বে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে আয়োজিত এ অধিবেশনে বিশ্বের ২০০টি দেশের ১৭,০০০ প্রতিনিধি যোগ দেন।
(৬) রিও +২০ঃ ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম ধরিত্রী সম্মেলন। ঐ সম্মেলনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এ পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে রক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় গঠন করা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ইস্যুগুলো দেখভাল করার জন্য জাতিসংঘের অঙ্গ-সংগঠন UNFCCC।
১৯৯২ সালের ঐ সম্মেলনের ঠিক ২০ বছর পর বিশ্ব নেতৃবৃন্দ আবার এ পৃথিবীর টেকসই উন্নয়নের কৌশল নির্ধারণের জন্য ব্রাজিলের সেই রিও নগরীতেই একত্রিত হয় ২০-২২ জুন ২০১২। এ সম্মেলনের মূল নাম হচ্ছে ইউনাইটেড নেশন কনফারেন্স অন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট, সংক্ষেপে বিশ্বব্যাপী যাকে 'রিও+২০' নামে অভিহিত করে। সম্মেলন শেষে 'কী ভবিষ্যৎ আমরা চাই' শীর্ষক ৪৯ পৃষ্ঠার অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়, যাতে ২৮৩টি সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার রয়েছে।
(৭) ভিয়েনা কনভেনশনঃ ওজোন স্তরের সুরক্ষা ও সংরক্ষণে ঐতিহাসিক ভিয়েনা কনভেনশন ১৯৮৫ সালের ২২ মার্চ অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় গৃহীত হয়, যা কার্যকর হয় ১৯৮৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট এটি সমর্থন করে। ভিয়েনা কনভেনশনের পূর্ণনাম Vienna Convention for the Protection of the Ozone Layer
(৮) বাসেল কনভেনশনঃ বিপজ্জনক বর্জ্য দেশের সীমান্তের বাইরে চলাচল এবং এদের নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কনভেনশন 'বাসেল'। এ কনভেনশন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট দেশসমূহ তাদের দেশের সীমান্তের বাইরে পদার্থ জাহাজে বহন করে অন্যত্র নিক্ষেপ করা হ্রাস করতে, বর্জ্যের পরিমাণ ও বিষাক্ততা হ্রাস এবং বর্জ্য উৎপাদন স্থলের যত নিকটে সম্ভব এ সমস্ত বর্জ্যের নিক্ষেপ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ১৯৮৯ সালের ২২ মার্চ সুইজারল্যান্ডের বাসেলে এ কনভেনশনটি গৃহীত এবং কার্যকর হয় ৫ মে ১৯৯২ বাংলাদেশ ১৯৯৩ সালের ১ এপ্রিল বাসেল কনভেনশন অধিগত বা সমর্থন করে।
(৯) UNFCC: বিশ্ব তাপমাত্রা বৃদ্ধি মোকাবিলায় ১৯৯২ সালের ৯ মে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জলবায়ুর পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘ রূপরেখা কনভেনশন (UNFCCC) তৈরি করা হয় এবং ১৯৯২ সালে ধরিত্রী সম্মেলনে তা স্বাক্ষর করা হয়। ১৯৯৪ সালের ২১ মার্চ তা কার্যকর হয়। বাংলাদেশ ১৯৯২ সালের ৯ জুন এ কনভেনশন স্বাক্ষর করে এবং ১৯৯৪ সালের ১৫ এপ্রিল তা অনুমোদন করে। UNFCC-এর পূর্ণনাম United Nations Framework Convention on Climate Change.
(১০) জীববৈচিত্রা সংক্রান্ত কনভেনশনঃ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, এর উপাদানসমূহের টেকসই ব্যবহার
বৃদ্ধি এবং জেনেটিক রিসোর্স ব্যবহারে সবাই যাতে সমভাবে উপকৃত হতে পারে, সে ব্যাপারে কার্যকরী ভূমিকা পালন করার লক্ষ্যে গঠিত হয় জীববৈচিত্র্য সংক্রান্ত কনভেনশন (Convention on Biological Diversity-CBD)। এটি ১৯৯২ সালের ৫ জুন ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে স্বাক্ষরিত হয়, যা কার্যকর হয় ১৯৯৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর। বাংলাদেশ ১৯৯২ সালের ৫ জুন স্বাক্ষর করে এবং অনুমোদন করে ১৯৯৪ সালের ৩ মে।
(১১) কার্টাগেনা প্রটোকলঃ জীবপ্রযুক্তির ব্যবহার দ্বারা পরিমার্জিত প্রাণের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ সংক্রান্ত 'কার্টাগেনা প্রটোকল' ২০০০ সালের ২৯ জানুয়ারি কানাডার মন্ট্রিলে গৃহীত হয়, যা কার্যকর হয় ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৩। বাংলাদেশ ২০০০ সালের ২৪ মে এটি স্বাক্ষর করে এবং অনুমোদন করে ২০০৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। কার্টাগেনা প্রটোকলের পুরো নাম Cartagena Protocol on Biosafety to the Convention on Biological Diversity.
(১২) কিয়োটো প্রটোকলঃ ১৯৯২ সালের ৯ মে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে UNFCCC কনভেনশনের সময় ভূমণ্ডলের তাপ বৃদ্ধি ও আবহমণ্ডলের পরিবর্তন রোধে উদ্যোগ নেয়া হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনেও তা আলোচিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৯৭ সালের ১১ ডিসেম্বর UNFCCC অনুসমর্থনকারী দেশসমূহ জাপানের কিয়োটো (দেশটির প্রাচীন রাজধানী) নগরীতে আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে এমন একটি প্রটোকল গ্রহণে সম্মত হয়।
এর আওতায় ১৯৯০ সালের স্তরকে ভিত্তিরূপে ধরে উন্নত দেশগুলো তাদের যৌথ নিঃসরণ ৬টি গ্রিনহাউস গ্যাস (Carbon di-oxide, Methane, Nitrous oxide, Sulphur hexafluoride, Hydrofluorocarbons and Perfluorocarbons) ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ৫.২ শতাংশ হ্রাস করবে। ২০০৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কিয়োটো প্রটোকল কার্যকর হয়। বাংলাদেশ ২০০১ সালের ২২ অক্টোবর এ প্রটোকল সমর্থন করে।
(১৩) মন্ট্রিল প্রটোকলঃ ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরে অবস্থিত ওজোন স্তরকে রক্ষার জন্য জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ও বিজ্ঞানীদের সময়োচিত তৎপরতায় কানাডার মন্ট্রিল শহরে ওজোন ক্ষয়কারী বস্তু সামগ্রী ফেজ আউট করার লক্ষ্যে 'মন্ট্রিল প্রটোকল' (Montreal Protocol) স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৮৯ সালের ১ জানুয়ারি তা কার্যকর হয়। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট মন্ট্রিল প্রটোকল সমর্থন করে। প্রটোকলটির পূর্ণনাম Montreal Protocol on Substances that Deplete the Ozone Layer

উপসংহারঃ

পরিবেশগত সমস্যা মানবসভ্যতার এক ভয়ঙ্কর বিপদ। মহান সৃষ্টিকর্তা চমৎকার সুন্দর এক স্বয়ংক্রিয় ভারসাম্য সৃষ্টি করে রেখেছেন আমাদের কল্যাণে। নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারছি, সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি ধ্বংস করে নিজেদের আজাব ডেকে আনছি। পরিবেশগত সমস্যা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিকভাবে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও তা যথেষ্ট নয়। তাছাড়া গৃহীত পদক্ষেপে বৃহৎ শক্তির নেতিবাচক অবস্থান, দরিদ্র দেশের ওপরে দোষারোপ চাপানো প্রভৃতি পরিবেশ সমস্যা দূর না করে নতুন সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। কাজেই আমাদের সকলের উচিত উন্নত- অনুন্নত, ধনী-দরিদ্র সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে মানবসভ্যতার ভয়ংকর অভিশাপ পরিবেশগত সমস্যা সমাধানে একযোগে কাজ করা।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url