বিশ্বায়ন বলতে কি বুঝায়-দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশে বিশ্বায়নের প্রভাব

বর্তমান বিশ্বে বিশ্বায়ন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। ইংরেজি ‘Globe’ থেকে ‘Globalization’ শব্দটি এসেছে, যার অর্থ বিশ্বায়ন। বিশ্বায়ন প্রধানত একটি প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়া সারা বিশ্বকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। জাতি-রাষ্ট্রের সীমানাকে দুর করে সমগ্র বিশ্বকে একটি গ্রামে (Global Village) পরিনত করেছে।
বিশ্বায়ন বলতে কি বুঝায়-দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশে বিশ্বায়নের প্রভাব
প্রকৃতপক্ষে, “Globalization is a process of development of the world into a single interest economic unit.” বিশ্বায়ন শব্দটি একটি বিশেষ অর্থনৈতিক স্বার্থের সাপেক্ষে সৃষ্টি হলেও অনিবার্যভাবে তার প্রতিভাস এসে পড়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মাত্রায়।
প্রশ্ন সমুহঃ
বিশ্বায়ন বলতে কি বুঝায়? বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্য ও সমস্যাসমূহ আলোচনা করুন। বিশ্বায়ন ও আঞ্চলিকতাবাদ কি একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী? (৩০তম বিসিএস।
অথবা, বিশ্বায়নের উদ্ভব ও বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণপূর্বক দরিদ্র দেশসমূহের ওপর এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে মন্তব্য করুন। (২৪তম বিসিএস)
অথবা, বিশ্বায়ন সুযোগ (Opportunities) এবং আশঙ্কার (Threats) সৃষ্টি করেছে। "দক্ষ জনগোষ্ঠীর জন্য রয়েছে সুযোগ-সুবিধা এবং অদক্ষদের জন্য আশঙ্কা।" -এই মন্তব্যের সাথে আপনি কি একমত? আলোচনা করুন। (২৯তম বিসিএস)

সুচিপত্রঃ- বিশ্বায়ন বলতে কি বুঝায়-দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশে বিশ্বায়নের প্রভাব

ভুমিকা

বিশ্বায়ন এখন সবার মুখে মুখে। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী সবার মুখেই শব্দটি শোনা যাচ্ছে অহরহ। বর্তমান বিশ্বে বহুল উচ্চারিত বিশ্বায়ন হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া (Process)।
বিভিন্ন দেশের national যে boundary-গুলো রয়েছে সেগুলো তুলে দিয়ে সমগ্র বিশ্বকে একটি গ্রামে (Global village) পরিণত করা যায়। আর তাই Internationalization, Multinationalization Liberalization, Dissemination ইত্যাদি শব্দগুলোকে এর কাছাকাছি অর্থে ব্যবহার করা যায়।

বিশ্বায়ন বলতে কি বুঝায়

বিস্ময়কর জটিল এই একুশ শতকের বাস্তবতার যুগে কোনো ধারণার সহজ সরল সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। কারণ এ যুগকে বলা হয় উত্তর-আধুনিককাল। যেখানে কোনোকিছুই সহজভাবে নির্ণয় বা সংজ্ঞায়িত করার উপায় নেই, বরং এর সবকিছুই সংজ্ঞাহীন কিংবা বহুমাত্রিক ও বহু আর্থিক সংজ্ঞাময়, যা আসলে পরস্পর বিরোধী। ঠিক তেমনি বিশ্বায়ন সম্পর্কে নানাজনে নানা ধরনের ধারণা জ্ঞাপন করে থাকেন। এখানে কয়েকটি ধারণা উপস্থাপন করা হলো-
(ক) বিশ্বায়ন হলো অনেকের জন্য অনেক কিছু করা;
(খ) বিশ্বায়ন হলো অর্থ ও সম্পদের অবাধ প্রবাহ;
(গ) বিশ্বায়ন হলো সীমানাবিহীন (Borderless) বিশ্ব;
(ঘ) বিশ্বায়ন হলো বিশ্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একত্রীকরণ;
(ঙ) সামাজিক দায়বদ্ধতার চেয়ে নিজ স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া;
(চ) বিশ্বায়ন ব্যবস্থা উদারীকরণের সমার্থক;
(ছ) বিশ্বায়ন হলো সীমানামুক্তকরণ ও আন্তর্জাতিকীকরণ;
(জ) বিশ্বায়ন ধারণার পেছনে রয়েছে মুক্তবাজার অর্থনীতি।
উপরিউক্ত সংজ্ঞায়ন থেকে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, বিশ্বায়নের কোনো স্বতঃসিদ্ধ সংজ্ঞা নেই। এর বিভিন্ন পণ্ডিতগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তাই সংক্ষেপে বিশ্বায়নের সংজ্ঞা প্রদান অত্যন্ত দুরূহ।

বিশ্বায়নের উদ্ভব ও বৈশিষ্ট্য

 ইংরেজি 'Globalization' বা 'বিশ্বায়ন' শব্দটি নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের গুপনা সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন। এটি একটি ধারণা (concept)। মজার ব্যাপার জাপার সীমান্তে নতুন নয়, এর অস্তিত্ব পূর্বেও ছিল, তবে ভিন্নভাবে এবং ভিন্ন গতিতে। একই কাজ যেমন অবস্থাভেদে আহার করা, খাওয়া ও গেলা হয়, ঠিক তেমনিভাবে বিশ্বায়নও একেক সময় একের রূপ ধারণ করে।

অতীতের কলম্বাস, ভাস্কো দা গামা, লিভিংস্টোন, এডওয়ার্ড কুকু-এর দুঃসাহসী সমুদ্র বিজয়ী অভিযাত্রীর ভৌগোলিক আবিষ্কার অথবা বিভিন্ন দেশের বণিকদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা অথবা হিউয়েন সাং, ফা-হিয়েন, আল বেরুনী, ইবনে বতুতা, মার্কো পোলোর মতো পরিব্রাজকদের বিশ্বসফরকে বিশ্বায়নের প্রাথমিক পর্যায় বা সূচনা বলা যায়।
আধুনিক বা আজকের বিশ্বায়ন বিভিন্ন কারণে স্বতন্ত্র। উরুগুয়ে রাউন্ড, গ্যাট, ডব্লিউটিও ইত্যাদি নামে আসলে সমগ্র বিশ্বকে একটি বাজারে পরিণত করার চেষ্টা চলে আসছে অনেক দিন হতেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর খুড়িয়ে চলা পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও দুই পরাশক্তির আদর্শিক দ্বন্দ্ব স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দেয়। তবে বর্তমানে যে 'বিশ্বায়ন'-এর কথা মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে এর সূচনা হয় সংস্কারবাদী সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ-এর 'পেরেস্ত্রৈকা' (Perestroika)

এবং 'গ্লাসনস্ত' (Glasnost) নীতি থেকে যেখানে গর্বাচেভ চেয়েছিলেন বিশ্ব ব্যবস্থার পুনঃসংস্করণ, উদারনীতি, নতুনভাবে বিশ্বচিন্তা, সকলের জন্য শান্তি, বৃহৎশক্তির মধ্যে সহযোগিতা এবং ঠাণ্ডা লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি। এক্ষেত্রে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের হেলসিংকি (ফিনল্যান্ড) অধিবেশনটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র জর্জ বুশ এ 'বিশ্বায়ন' ধারণাটির বহুল প্রয়োগ ও ব্যবহার নিশ্চিত করেন। বিশ্বায়ন এখন এগিয়ে চলছে দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে।
বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিচে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হলো-
(১) বিশ্বায়ন বিশ্বকে একমেরুকেন্দ্রিকতা থেকে বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বে পরিণত করেছে।
(২) বিশ্বায়ন বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। দেশে-দেশে মানুষে-মানুষে গুরুত্ব হ্রাস করেছে, অপরিচিতি, ব্যবধান কমে আসছে।
(৩) বিশ্বায়ন মানুষে-মানুষে দেশে-দেশে ভাষাগত, আচার-আচরণগত ব্যবধান কমিয়ে দিচ্ছে। সারা পৃথিবী যেন হয়ে উঠেছে মানুষের নিজের দেশ। মানুষ ক্রমেই যেন হয়ে উঠেছে বিশ্ব নাগরিক।
(৪) বিশ্বায়ন মানুষে-মানুষে ভাষা ও সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটিয়ে বিশ্ব সভ্যতার উন্নতিও ত্বরান্বিত করছে।
(৫) বিশ্বায়ন একলা চলার নীতি রোধ করে 'দশে মিলি করি কাজ' নীতির প্রসার ঘটিয়েছে।
(৬) বিশ্বায়ন নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদের প্রসার ঘটিয়েছে নতুন নীতি ও নতুন ভঙ্গিতে।
(৭) বিশ্বায়ন দরিদ্র দেশের লোক-সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
(৮) বিশ্বায়ন উৎপাদন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে।
(৯) বিশ্বায়ন শিক্ষার ক্ষেত্র প্রসার করার পাশাপাশি শিক্ষাকে পণ্যে রূপান্তরিত করেছে।
(১০) বিশ্বায়ন যোগাযোগ ক্ষেত্রে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
(১১) বিশ্বায়ন পূর্বের এককেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন করে বহুকেন্দ্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে।
(১২) বিশ্বায়ন পণ্য ও সেবার মান উন্নত করে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে।
(১৩) বিশ্বায়ন ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রসার ঘটিয়েছে। এর মাধ্যমে উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে বিশ্বময় প্রসারিত করতে পারছে।
(১৪) বিশ্বায়ন সন্ত্রাস ও অপরাধ জগৎকে প্রসারিত করে দিয়েছে।
(১৫) বিশ্বায়ন পরিবেশগত সমস্যা দিন-দিন বৃদ্ধি করে চলেছে। ফলে পরিবেশ দিন দিন মানুষের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে বিশ্বকে মনুষ্য বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে।
(১৬) বিশ্বায়ন তথ্য ও প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ প্রসারিত করার পাশাপাশি যৌনতা-হিংস্রতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছে।
(১৭) বিশ্বায়ন বহুজাতিক কোম্পানির দৌরাত্ম্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
(১৮) বিশ্বায়ন মানুষে-মানুষে দেশে-দেশে সন্দেহ ও অবিশ্বাস হ্রাস করে দিয়েছে।
(১৯) বিশ্বায়ন আঞ্চলিকতাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রসার ঘটিয়েছে। গড়ে তুলেছে বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন (EU, AU, ASEAN), যা সহযোগিতামূলক বিশ্ব ব্যবস্থার নিদর্শন।
(২০) বিশ্বায়ন সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে প্রসারিত করছে। স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে মানুষের আচার-আচরণ, মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনা, জীবনযাপন, পরিবার ব্যবস্থা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।

দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশে বিশ্বায়নের প্রভাব

বিশ্বায়নের ক্রমবর্ধমান প্রতিক্রিয়া উন্নত-অনুন্নত রাষ্ট্রের মানুষের জীবনে নানাভাবে প্রভাব ফেলেছে। কোথাও এ প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক আবার কোথাও তা নেতিবাচক। একই প্রজন্মের ক্ষেত্রে স্থান বিশেষে কোথাও নিয়ে এসেছে সমৃদ্ধি আবার কোথাও নেমেছে অর্থনৈতিক ধস। তবে বিশ্বায়নের প্রতিক্রয়া সবচেয়ে বেশি দরিদ্র দেশসমূহে। নিচে ধারাবাহিকভাবে দরিদ্র দেশসমূহে বিশ্বায়নের প্রতিক্রিয়া উপস্থাপন করা হলো-
(১) ধনী-দরিদ্র বৈষম্য ও মানব বঞ্চনাঃ বিশ্বের ধনী ১ ভাগ মানুষ ৫৭ ভাগ দরিদ্র মানুষের সমান আয় করে। আমেরিকার ধনী ১০ ভাগ জনগণের আয় বিশ্বের ৪৩ ভাগ দরিদ্র জনগণের সমান। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বের দরিদ্রের শতকরা হার ছিল ১৩.১ ভাগ যা ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে এসে দাঁড়িয়েছে ১৭.১ ভাগে। বিশ্বে পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২৬০ কোটি। পানীয় জল সুবিধাবঞ্চিত মানুষ ১৮০ কোটি, পুষ্টি সুবিধাবঞ্চিত মানুষ ৮৪ কোটি। বিশ্বের ১৫০ কোটি মানুষ ১০০ বছর বয়স হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করে।
(২) শিক্ষাব্যবস্থাঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব মারাত্মক। শিক্ষাব্যবস্থা বিগত দেড়শ বছরেও এমন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বিশ্বায়নের ফলে হারাচ্ছে তার মর্যাদা, স্বকীয়তা। উচ্চ শিক্ষা সাধারণ শিক্ষায় পর্যবসিত হয়েছে। শিক্ষা রূপান্তরিত হচ্ছে পণ্যে। হারাচ্ছে তার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কেন্দ্রবিন্দু। মেধাস্বত্ত্ব ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির পেটেন্ট বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কিনে নিচ্ছে। যার ফলে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান উৎপাদনক্ষম হচ্ছে না। পাশ্চাত্যে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ভীড় বেড়ে গেছে।
(৩) ভাষার গোলক ধাঁধাঃ বিশ্বায়নের প্রভাবে বিশ্বের প্রায় ৭ হাজার ভাষার মধ্যে প্রতি সপ্তাহে দুটি এবং প্রতিবছর শতাধিক ভাষা অপমৃত্যুর কবলে পড়ছে। এ মৃত সারিতে নাম লিখিয়েছে ম্যাসাচুসেটের ক্যাটওয়া, আলাস্কার ওয়াক, লাটভিয়ার লিভোনিয়ান। বিশ্বের ৬০ থেকে ৯০ ভাগ ভাষা অদূর ভবিষ্যতে এমনি পরিণতি লাভ করবে। ২০৫০ খ্রিস্টাব্দে ৩৫০ কোটি লোকের ভাষা হবে ইংরেজি। বিশ্বের প্রতিটি দরিদ্র দেশে মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা স্থান করে নিচ্ছে। মানুষ নিজেকে স্মার্ট করে নেয়ার জন্য মাতৃভাষার মধ্যে ইংরেজি, জাপানি, ফার্সি, আরবি ভাষার মিশ্রণ ঘটাচ্ছে। এভাবে আপ-টু-ডেট হওয়ার প্রবণতা দরিদ্র দেশের সর্বত্র বৃদ্ধি পাচ্ছে।
(৪) সাংস্কৃতিক আগ্রাসনঃ বিশ্বায়নের নমে মানুষকে যেভাবে স্যাটেলাইট চ্যানেল পশ্চিমা সংস্কৃতি সরবরাহ করছে, তাকে নিঃসন্দেহে 'সাংস্কৃতিক আগ্রাসন' বলে বর্ণনা করা যায়। সাংস্কৃতিক এ আগ্রাসনকে অনেকে 'সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ' বলে চিহ্নিত করেছেন। বিশ্বায়ন একটি দেশের মূল্যবোধ, সমাজবীক্ষণ ও জীবনযাপনের ধ্যান ধারণাকে সুকৌশলে অনুন্নত দরিদ্র দেশের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। আর এটাই ঘটছে বিশ্বজুড়ে।
এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমাজ জীবন ক্রমাগত এ সাম্রাজ্যবাদের আওতায় এসে পড়ছে। এসব দেশের মানুষের আচার-আচরণে, ভাবনা-চিন্তায় যা কিছু দেশজ তাকে সরিয়ে দিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুষঙ্গ।
(৫) সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনঃ দিন দিন বিশ্বায়নের প্রভাবে দরিদ্র দেশের সমাজ ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। যৌনতা, হিংস্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতীয় বা আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ বিশ্ব সন্ত্রাসবাদে রূপ নিচ্ছে। তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন দুর্ধর্ষ গেরিলা সংস্থা। দেহ ব্যবসা বিশ্ব বাণিজ্যের অংশে পরিণত হয়েছে। প্রবীণদের সমস্যা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। একান্নবর্তী পরিবারগুলো দ্রুত ভেঙে পড়ছে। মানুষ হয়ে উঠছে আত্মকেন্দ্রিক। যত দিন যাচ্ছে এ সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদে, আচার-আচরণে, মূল্যবোধে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণ প্রতিভাত হচ্ছে। বিনোদনের মাধ্যম সঙ্গীত ব্যবস্থায় পাশ্চাত্য রক অ্যান্ড রোল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দিন দিন হিপ্পিদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
(৬) যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ বিশ্বায়নের অন্যতম ইতিবাচক দিক হলো যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত পরিবর্তন। অতীতের হাতি বা ঘোড়া বা গরুর গাড়ি, নৌকা, পালকি বর্তমানে সাইকেল, মোটর সাইকেল, ট্রেন, যন্ত্রচালিত নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার, বিমান, মাইক্রোবাস, বাস দখল করে নিয়েছে। জীবনকে যোগাযোগ ব্যবস্থা গতিশীল করে তুলেছে। সময়কে অনেক বাঁচিয়ে দিয়েছে এবং যাতায়াতকে করেছে আরামপ্রদ।
(৭) পুঁজি প্রবাহ ও ব্যবসা-বাণিজ্যঃ বিশ্বায়নে পুঁজি অবাধে আসবে, অবাধে যাবে। কিন্তু বাস্তবে উন্নয়নশীল দেশে এ পদক্ষেপ গ্রহণের পর পুঁজি কেবল বাইরের দিকে যেতেই থাকে। এ ব্যবস্থায় পুঁজি একটি দেশে প্রবেশ করে শেয়ার বাজার ও রিয়েল স্টেট ব্যবসায় ফটকাবাজির জনা। তারপর বহুগুণে স্ফীত হয়ে সামান্য ঝড়ের আভাসেই ছুটে পালায়। বিশ্বায়নের মূল চালিকাশক্তি হলো ব্যবসা-বাণিজ্য। শিল্পপণ্যের বাণিজ্য গত ৫০ বছরে ১শ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে যেখানে বিশ্ব বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৯৫ বিলিয়ন ডলার, বর্তমানে এ পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৯,৯৩৫ বিলিয়ন (বিশ্ব বাণিজ্য রিপোর্ট ২০১০) ডলারে। ব্যবসা-বাণিজ্য খাত অর্থনীতির অন্যান্য খাত থেকে দ্রুততম সময়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিশ্বের সম্ভাবনাময় স্থানে পুঁজি বিনিয়োগ করে এ বিনিয়োগকৃত দেশকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে অসহায় হয়ে পড়ছে নির্ভরশীল দরিদ্র দেশগুলো। বহুজাতিক কোম্পানির প্রেসক্রিপশনে দরিদ্র দেশগুলোকে সকল নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
(৮) পরিবেশ ব্যবস্থাঃ বিশ্বায়ন পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। নতুন ভোগ্য পণ্যের চাহিদা মেটাতে উৎপাদন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ মাত্রা শিল্পায়িত এ যুগে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পরিবেশে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ওজোন স্তরে ফাটল বেড়ে যাচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর জন্য দায়ী উন্নত বিশ্ব। কিন্তু এ দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে দরিদ্র বিশ্বের ঘাড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্র দেশগুলো। আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তনে বিশ্বে দিন-দিন বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, দাবানল, ভূমিকম্প বেড়েই চলেছে।
(৯) কৃষি ও চিকিৎসাব্যবস্থাঃ বিশ্বায়ন কৃষিক্ষেত্রে দরিদ্র বিশ্বে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। পূর্বে মানুষ কৃষিকাজে লাঙ্গল, জোয়াল, মই ব্যবহার করতো। এখন সেখানে ট্রাক্টর ব্যবহার করছে। কৃষি উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে জৈব সারের পরিবর্তে রাসায়নিক সার ব্যবহার করছে। কৃষি আবাদে সেচ যন্ত্র হিসেবে দোন বা সেঁওতি ব্যবহারের পরিবর্তে স্যালো মেশিন ব্যবহার করছে।

আগে শিক্ষার অভাবে সাধারণ মানুষ পীর-ফকিরের ঝাড়-ফুঁক, পানি-পড়া, তাবিজ-কবজ, মানত, দান-দক্ষিণায় বিশ্বাস করে আপদ-বিপদ থেকে মুক্তিলাভের চেষ্টা করত। কিন্তু বর্তমানে মানুষ শিক্ষিত হওয়ার ফলে, আর্থিক সামর্থ্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে। এককালের কলেরা-বসন্ত মহামারী থাকলেও আজ তা প্রায় বিলুপ্তির পথে, উন্নত ঔষধ আবিষ্কার হওয়ার ফলে।

আগের দিনে লোকে পীর-ফকিরের দ্বারস্থ হতো, তারা তন্ত্র-মন্ত্রের সাহায্যে গ্রাম বন্ধন, দেহ বন্ধন, ঘর বন্ধন করে রোগ প্রতিরোধের চেষ্টা করত। এ অবস্থা এখন বিদূরিত প্রায়। এখানেই মানুষের চেতনা ও মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটেছে। পুরানো বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে আস্থা জন্মেছে। পরিবারের জনসংখ্যা হ্রাসে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করে জন্ম শাসনে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।

উপসংহার

বিশ্বায়ন যে পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয়েছিল তাতে দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বেশি- যদি এ বিশ্বায়ন পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন না হতো। বর্তমান বিশ্বায়নে সম্পদশালীরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। আর দরিদ্র দেশগুলো দিন দিন দরিদ্র হয়ে পড়ছে। কিন্তু বর্তমান অবস্থার প্রক্ষাপটে বিশ্বায়নের এ প্রক্রিয়াকে থামিয়ে রাখা বা বাধাদান করা সম্ভব নয়। বিশ্বায়নকে যতই আমরা অপদস্থ করি না কেন এ বৃহত্তম প্রক্রিয়া থেকে দরিদ্র দেশগুলোর বের হওয়া সম্ভব নয়।

কাজেই এখন যা উচিত তা হলো দরিদ্র দেশসমূহকে ভেবে-চিন্তে সুবিধা-অসুবিধার কথা মাথায় রেখে এগিয়ে যেতে হবে যাতে তারা এ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া থেকে লাভবান হতে পারে। পাশাপাশি উন্নত ধনী পুঁজিবাদী দেশসমূহকে শোষদের মানসিকতা পরিত্যাগ করতে হবে। অন্যথায় বিশ্বায়ন বিশ্বকে মারাত্মক বিপদে ফেলবে। বিশ্বকে করে তুলবে বসবাসের অযোগ্য। এ বিরূপ পরিবেশ থেকে কারো রেহাই থাকবে না।

আপনার সচরাচর জিজ্ঞাসা

বিশ্বায়ন কাকে বলে?

বিশ্বায়ন হলো পারস্পারিক ক্রিয়া ও আন্তসংযোগ সৃষ্টিকারী এমন একটি পদ্ধতি যা বিভিন্ন জাতির সরকার, প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের মাধ্যমে সমন্বয় ও মিথস্ক্রিয়ার সূচনা করে। অন্যভাবে বলা যায়, বিশ্বায়ন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার সাহায্যে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংস্থাসমূহ বিশ্বজুড়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক গড়ে তোলে।

কোন কোন বিষয়ের উপর বিশ্বায়ন প্রভাব বিস্তার করে?

ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন ক্ষেত্র যেমন- আন্তর্জাতিক বানজ্যি, কর, যোগাযোগ প্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক ভ্রমন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সংস্কৃতি প্রভুতি বিষয়ের উপর বিশ্বায়ন প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url