রেশম চাষ কি-রেশম চাষের পদ্ধতি ও রেশম চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
ইংলিশে রেশম চাষকে Sericulture বা (সেরিকালচার) বলে। আভিধানিক অর্থে
(Sericulture) মানে রেশম চাষ বিদ্যাকে বোঝানো হয়। রেশম পোকার চাষের মাধ্যমে
Culture of Sericine বা সেরিসিন নামে এক ধরণের প্রোটিন পদার্থ উৎপাদন করা হয়।
রেশমের মূল গাঠনিক পদার্থকে ‘সেরিসিন’ বলে।
অর্থাৎ, যে জীব বা প্রণী সেরিসিন নামক প্রোটিন বস্তু তৈরি করে এবং লালন-পালন করে
সেই পদ্ধতিকে সেরিকালচার বা (Sericulture) বা রেশম চাষ বিদ্যা বলে। সেরিকালচার
প্রাণিবিজ্ঞান শাখার অন্যতম একটি প্রধান শাখা।
সূচিপত্রঃ
রেশম বা তন্তু কি
আমরা যে সিঙ্ক বা রেশমী কাপড় ব্যবহার করি তা রেশম মথ নামে এক ধরনের মথের মূককীটের
লালাগ্রন্থি বা রেশম গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রসের তৈরী তন্তু বা রেশমী সূতা হতে তৈরী
হয়। রেশম মথ আর্থ্রোপডা (Arthropoda) পর্বের অন্তর্ভুক্ত ইনসেক্টা (Insecta)
শ্রেণীর পতজ্ঞা। রেশম মথের লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রস বাতাসের সংস্পর্শে এসে
শুকিয়ে রেশম সুতায় পরিণত হয়।
রেশম সূতা অত্যন্ত সূক্ষ্ণ, লম্বা, স্থিতিস্থাপক এবং উজ্জ্বল। রেশমী কাপড় সারা
পৃথিবীতে সুন্দর ও মূল্যবান কাপড় হিসাবে সমাদৃত। রেশম মথ বিভিন্ন প্রজাতির হয়।
এরা বিভিন্ন মানের রেশম সূতা তৈরী করে। যেমন-
(ক) তুতজাত রেশম মথ: এরা সবচেয়ে উন্নত মানের সিল্ক সূতা তৈরী করে।
(খ) এন্ডি রেশম মথ: এরা এন্ডি নামে রেশমী সূতা তৈরী করে।
(গ) তসর রেশম মথ: এরা তসর নামে রেশমী সূতা তৈরী করে। এসব রেশমী সূতার মধ্যে
ভূঁতজাত রেশম মথ কর্তৃক তৈরী রেশম সূতা থেকেই সর্বাপেক্ষা মূল্যবান রেশমী কাপড় বা
সিল্ক তৈরী হয়।
রেশম চাষের ইতিহাস
খৃীষ্টের জন্মের প্রায় দুই হাজার বৎসর আগে চীন দেশে রেশম সূতা আবিষ্কার হয়। এরপর
থেকে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার বৎসর পর্যন্ত চীনারা একচেটিয়াভাবে অত্যন্ত
গোপনীয়তার সাথে রেশমী সূতা ও রেশমী কাপড় তৈরী করতো। খৃষ্ট জন্মের প্রায় সাড়ে
পাঁচশত বৎসর পর দুজন ইউরোপীয় পাত্রী কৌশলে রেশম উৎপাদন করার কলা কৌশল শিখে ফেলেন
এবং কিছু রেশম পোকার ডিম গোপনে ইউরোপে পাঠিয়ে দেন। ঐ সময় থেকেই ইউরোপে রেশম চাষ
শুরু হয়।
বর্তমানে জাপান, চীন, ইটালী, রাশিয়া, ভারত, ব্রাজিল ইত্যাদি দেশ উন্নতমানের
রেশমসূতা ও রেশমী কাপড় তৈরী করে এবং রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন
করে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন প্রজাতির রেশম মথের চাষ হয়। এর মধ্যে ময়মনসিংহ,
টাঙ্গাইল, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর এবং বগুড়ায় রেশম পোকার চাষ হয় রাজশাহীর
আবহাওয়া এবং মাটির বৈশিষ্ট্য ভূত গাছ উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী বলে রাজশাহীতে
প্রধান ভূঁতজাত রেশম পোকার চাষ হয়ে থাকে।
রেশম চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
(১) রেশম সূতা বেশ কিছুটা আর্দ্রতা ধারণ করতে পারে বলে এই সূতার তৈরী বস্ত্র শীত,
গ্রীষ্ম উভয় ঋতুতেই ব্যবহার করা হয়।
(২) রেশমী সূতা বিদ্যুৎ অপরিবাহী বলে এই সূতা দিয়ে বৈদ্যুতিক তারের ইনসুলেটর
আবরণী তৈরী হয়। (৩) রেশমী সূতা সার্জিক্যাল সূতা হিসাবে অস্ত্রপচারের সময়ে
ব্যবহার করা হয়।
(৪) রেশমসূতার তৈরী কাপড় রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়।
(৫) বাংলাদেশে উৎপাদিত রেশমীবস্ত্র, আমাদের বস্ত্র সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রাখে।
(৬) রেশম উৎপাদনকারী ফার্ম ও কলকারখানায় চাকুরী করে অনেকের কর্মসংস্থান হয় ও
বেকার সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়। vii. রেশমচাষের আর। ঘরে বসে গৃহিনীরাও অল্প
পরিশ্রমে ও অল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে সংসারের সচ্ছলতা আনতে
পারে।
(৭) পিউপার দেহ- নিঃসৃত তেল ও দেহাবশেষ হাঁস-মুরগীর খাদ্য হিসাবে এবং জমির সার
হিসাবে কাজে লাগে।
রেশম চাষ পদ্ধতি
রেশম চাষ কি? রেশমী সূতা উৎপাদন এবং রেশমী বস্ত্র তৈরীর উদ্দেশ্যে বিজ্ঞান
সম্মতভাবে রেশমমথ পালন করার এবং তার গুটি বা কোকুন থেকে রেশমী সূতা সংগ্রহ করার
সার্বিক প্রক্রিয়াকে রেশম চাষ বা রেশম মথের চাষ বলে। বাণিজ্যিক ভাবে রেশম চাষ
অত্যন্ত লাভজনক।
তুঁতজাত রেশম মথের জীবনচক্র
যে ধারাবাহিক ধাপসমূহ অতিক্রম করার মাধ্যমে কোন জীব জাইগোট দশা থেকে প্রজননক্ষম
পূর্ণাঙ্গ দশায় 'পরিণত হয়, তাকে জীবন চক্র বলে। কোন জীবের জীবন চক্রের ধাপগুলো
চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে। সব প্রজাতির রেশমমথের জীবন ইতিহাসেই সাধারণভাবে
চারটা ধাপ চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে। যথা-
(ক) ডিম, (খ) শুককীট বা লার্ভা বা পলু, (গ) মূককীট বা পিউপা এবং (ঘ) পূর্ণাঙ্গ
মথ।
জীবনচক্র ও রেশম চাষ
(১) ডিম সংগ্রহঃ পূর্ণাঙ্গ পুরুষ ও স্ত্রী রেশম মথ উড়ন্ত অবস্থায় স্ত্রী
মথের দেহে ডিম, নিষিক্ত হয়ে জাইগোটে পরিণত হয়। এরপর পরই পুরুষ মথ মারা যায়।
স্ত্রী মথ এরপর ডিম পাড়া শুরু কলে। ডিম সংগ্রহ করার জন্য স্ত্রী মথকে কাগজ বিছানো
বাঁশের ডালায় ডিম পাড়তে দেওয়া হয়। স্ত্রী মথের দেহ নিঃসৃত এক ধরনের আঠানো
পদার্থের সাহায্যে ডিমগুলো ডালার কাগজে লেগে যায়। স্ত্রী মথ এক সাথে ৩০০-৫০০ টা
ডিম পেড়ে থাকে। ডিমগুলো দেখতে সরিষার দানা বা ছোট ছোট পুঁথির মত এবং হলুদ রঙে।
ডিম পরিস্ফুটিত হয়ে পলু বা শূককীট বের হয়। ডিম ফুটতে গ্রীষ্মকালে ৮-১০ দিন লাগে।
তাপমাত্রা কম থাকলে ডিম ফুটতে আরও বেশী সময় লাগে।
(২) শুককীট বা লার্ভাঃ শূককীট সরু, ছোট এবং বাদামী রঙ্গের। শূককীটের মাথায়
একজোড়া ক্ষুদ্র সংবেদী শৃঙ্গ ও শূককীটের বক্ষে তিন জোড়া সন্ধিযুক্ত এবং নখর
বিশিষ্ট পা আছে। এই নখর খাওয়ার সময় তুঁত পাতাকে ধরে রাখে। শূককীটের উদরে পাঁচ
জোড়া সন্ধিবিহীন উপপদ আছে। এ গুলো চলনে সহায়তা করে। শূককীট দশাই রেশম মথের সক্রিয়
দশা এবং গ্রীষ্মকালে প্রায় ২০-২৫ দিন শূককীট দশা বিদ্যমান থাকে নবজাত শূককীটকে
কচি ভূঁতপাত খুব ছোট ছোট কুচি করে কেটে খেতে দেওয়া হয়। এরা ক্রমে ক্রমে বড় হতে
থাকে। এর মধ্যে শূককীট চারবার খোলস বদলায়। পরিণত শূককীট প্রায় ৬০ মি. মি. লম্বা
হয়। বেশী করে তুঁতপাতা খেতে দিলে শুককীটের দৈহিক বৃদ্ধি ভালো হয়। বড় শূককীট থেকে
বড় গুাট তৈরী হয়, ফলে উন্নত মানের রেশম সূতা পাওয়া যায়। শূককীট দশার শেষে মূককীট
দশা শুরু হয়।
(৩) মূককীট (পিউপা): শূককীট দশ্যর শেষের দিকে রেশমপোকা পাতা খাওয়া বন্ধ
করে এবং ফলে এদের দেহ সঙ্কুচিত হয়ে যায়। এ সময় শুককীট তার দেহের চারদিকে মাথা
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গুটি তৈরী করে। গুটির ভিতরেই অবস্থান করতে থাকে এবং মূককীটে পরিণত
হয়। মূককীটের লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রসে সূতার মত তত্ত্ব তৈরী হয়। এই তন্তু
বাতাসের সংস্পর্শে এলে শত্রু হয়ে ডিম্বাকৃতি গুটি বা কোকুন গঠন করে। গুটি তৈরী
হতে ৩-৪ দিন লাগে। গুটির ভিতরের মূককীটকে 'পুণ্ডুলি'ও বলে। মূককীট এরপর গুটির
ভিতরে রূপান্তরিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ মথে পরিণত হয়। এসময় মূককীট কিছু খায় না এবং
নিষ্ক্রিয় থাকে। আট- দশ দিন মূঝকীট দশা পার চূর্ণর পর কোকুনের একপ্রান্ত কেটে
পূর্ণাঙগ মথ বের হয়ে আসে।
পূর্ণাঙ্গ মথঃ পূর্ণাঙ্গ মথের মাথায় একজোডা বড় পালকের মত শুঁড় থাকে। এদের
বুকে তিন জোড়া পা এবং পিঠে দুই জোড়া পাখা থাকে। কিন্তু মথ বেশী ভালো করে উড়তে
পারে না। পুরুষ মথ সাধারণতঃ একদিন এবং স্ত্রী মথ সাধারণতঃ ৩-৪ দিন বাঁচে। ডিম
দেবার পর স্ত্রী মথ মারা যায়। বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড এর বীজাগারে উন্নত
প্রজাতির রেশম বা গুটি পাওয়া যায়। প্রয়োজনমত ঐসব বীজাগার থেকে উন্নতজাতের এবং
রোগমুক্ত সুস্থ বীজ সংগ্রহ করা যায়।
রেশম পোকার রোগ ও চিকিৎসা
রেশম মথের শূককীট কটারোগ, কালশিরারোগ, রসারোগ ও চূর্ণাকাঠিরোগ ইত্যাদি রোগে
আক্রান্ত হতে পারে। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ছত্রাক এবং নানা ধরনের পরজীবীর আক্রমণে
এসব রোগ হয়।
কটারোগ (Pebrin): এক ধরনের প্রোটোজোয়ার আক্রমনে কটারোগ হয়। এ রোগে
আক্রান্ত শূককীটের দেহে গোলমরিচের মত কালো কালো দাগ্ন হয় এবং শূককীট অপুষ্টির
কারণে মারা যায়।
চিকিৎসাঃ
(১) এ রোগ দমন করার জন্য আক্রান্ত শূককীট সরিয়ে ফেলতে হয়।
(২) উপযুক্ত জীবাণুনাশকের দ্রবণে রোগমুক্ত ডিমগুলো কয়েক মিনিট রেখে বিশোধিত করে
পরে ভালো পানিতে ধুয়ে ফেলতে হয়। রেশম সংগ্রহ প্রক্রিয়া সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: এই
প্রক্রিয়া কয়েকটা ধাপে ঘটে। যেমনঃ
(ক) গুটি তৈরি হয়ে যাবার পর প্রথমে সেগুলোকে একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে হয়।
ফলে মূককীট মারা যায়। তানাহলে মূককীট কয়েকদিনের মধ্যেই কোকুন বা গুটি কেটে বের
হয়ে যায়। তাহলে সূতার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে যায়।
(খ) গুটিগুলোকে এরপর কিছুক্ষণ সিদ্ধ করতে হয়। এতে গুটির আঠালো পদার্থগুলো অপসারিত
হয়ে যায়। এতে সহজেই গুটি থেকে সূতো ছাড়িযে নেওয়া যায়।
(গ) আট দশটা গুটির সূতো একসাথে রিল এ জড়িয়ে রেশম সংগ্রহ করা হয়। প্রায় ৭০০০ টা
গুটি থেকে মাত্র এক কিলোগ্রাম সূতা পাওয়া যায়।
(ঘ) সবগুলো মেরে না ফেলে পরবর্তী বীজ হিসাবে ব্যবহার করার জন্য কিছু গুটি রেখে
দিতে হয়।
বাংলাদেশে রেশম চাষের বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাবনা
বৃহত্তর রাজশাহী জেলায় সরকারী পর্যায়ে রেশম চাষের গবেষণা কেন্দ্র সৃষ্টি হয়েছে।
এই গবেষণা কেন্দ্র বিপুল এবং সোনালী নামে দুটো উন্নত জাতের রেশম পোকা উদ্ভাবন
করেছে। তুঁতজাত রেশম পোকার শূককীট ভূঁতপাতার কচিপাতা খেয়ে বাঁচে বলে এই রেশম মথের
চাষ করার জন্য প্রচুর তুঁতগাছ প্রয়োজন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড,
স্থাপিত হয়েছে। এই বোর্ড ক. ভূঁতপাতার চাষ, খ. গুটি উৎপাদন এবং গ. বস্ত্রবুনন এই
তিন ধরনের কাজের উন্নয়নের দায়িত্ব পালন করে।
তুঁত গাছের চাষ (Cultivation of Mulberry)
রেশম পোকার শূককীট ভূঁত গাছের পাতা ও রস খেয়ে বাঁচে। এজন্য রেশমচাষের জন্য তুঁত
চাষ অপরিহার্য। বাংলাদেশের বিশেষ করে রাজশাহীর ভোলাহাট, শিবগঞ্জ, রোহনপুর, ও তার
আশেপাশের এলাকাসমূহে এবং ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, পাবনা, বগুড়া দিনাজপুর ইত্যাদি
অঞ্চলে প্রচুর তুঁতগাছ জন্মে। 'গাছ ছ'মাসের হলেই পাতা তোলা শুরু হয়। বছরে কমপক্ষে
৪/৫ বার পাতা সংগ্রহ করা যায়। বাংলাদেশের প্রধানতঃ দুধরনের তৃতপাতার চাষ হয়। দেশী
তুঁতপাতার পত্রফলকটা অনেক খন্ডাংশযুক্ত। এসব গাছের বৃদ্ধি কম ও পাতাও কম হয়। তবে
রেশম গবেষণাগারের উদ্ভাবিত উন্নতজাতের তুঁতগাছ থেকে বছরে হেক্টরপ্রতি ২৭ মেট্রিক
টনেরও বেশী তুঁতপাতা পাওয়া যায়। তুঁতগাছের বিভিন্ন ধরনের ছত্রাক জনীত রোগ হয়।
উন্নত ফলনের জন্য তুঁতগাছকে রোগ থেকে মুক্ত রাখা আবশ্যক।
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url