বনভূমি ধ্বংসের কারণ ও ফলাফল
বন হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ। জীবনধারণ ও বাস্তুতান্ত্রিক প্রক্রিয়া
পরিচালন, জীব বৈচিত্র্য রক্ষা এবং কোনো প্রজাতি ও বাস্তুতন্ত্রের ব্যবহার যেন
নবায়নযোগ্য হয় তার দিকে পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের দৃষ্টি থাকা উচিত।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই আজ বনভূমি
ধ্বংসের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। গত একশ বছরে ১.৫ বিলিয়ন হেক্টর আর্দ্র বনের
অর্ধেকটাই উজাড় হয়ে গেছে। প্রত্যেক দেশের জন্য তার আয়তনের অন্তত ২৫ ভাগ এলাকায়
বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে এর পরিমাণ ৫-৭ ভাগের বেশী হবে না বলে
বিজ্ঞানীদের ধারণা।
সূচিপত্রঃ- বনভূমি ধ্বংসের কারণ ও ফলাফল
বনভূমি ধ্বংসের কারণ
(১) নির্মাণ সামগ্রী আহরণঃ ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্র, কৃষিযন্ত্রপাতি, প্যাকিং
বাক্স ও ম্যাচ, নৌকা, টেলিফোন ও বিদ্যুতের খুঁটি, রেলের ড্রিলারসহ আরও অনেক
সামগ্রী নির্মাণে নির্বিচারে বন থেকে কাঠ আহরণ বনভূমি ধ্বংসের অন্যতম প্রধান
কারণ।
(২) জ্বালানীঃ বসতি, ইটের ভাঁটা ও শেষকৃত্যানুষ্ঠানে প্রচুর জ্বালানীর
প্রয়োজন হয়। উন্নয়নশীল দেশে তা বনভূমি থেকেই আসে। বিকল্প জ্বালানীর আবিষ্কার না
হলে এ অবস্থা চলতেই থাকবে।
(৩) দূষণঃ জীবাশ্ম জ্বালানী কিংবা কল-কারখানা নির্গত অসংখ্য দূষককণা গাছের
পাতায় জমে পত্ররন্দ্র বন্ধ করে গাছের সালোকসংশ্লেষণ ও বৃদ্ধিতে বিঘ্ন ঘটিয়ে গাছকে
দুর্বল করে ধ্বংস ত্বরান্বিত করে।
(৪) বসতি স্থাপনঃ জনবিস্ফোরণের প্রেক্ষিতে বনভূমি সাফ করে মানববসতি স্থাপন
ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
(৫) অভিবাসনঃ ঘনবসতিপূর্ণ জায়গা থেকে লোকজন কিছুটা জনবিরল জায়গায় বসবাসের
উদ্দেশে বনভূমি পরিস্কার করেছে।
(৬) কৃষিজমি সম্প্রসারণঃ ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর আহার জোগানোর উদ্দেশে
বনভূমি সংকুচিত করে কৃষিজমির সম্প্রসারণ ঘটানো হয়েছে।
(৭) নগদ অর্থকরী গাছ রোপনঃ ক্যাশ রূপ নামে পরিচিত রাবার, তুলা প্রভৃতি
গাছের ব্যাপক উৎপাদনের জন্য বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে।
(৮) বিভিন্ন স্বাধনাঃ মানব উন্নয়নে প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্দেশে বনভূমি
ধ্বংস করে নানান কল-কারকানা স্থাপন করা হয়েছে।
(৯) অবৈজ্ঞানিক বনায়নঃ ক্ষতিগ্রস্ত বনভূমির ক্ষতিপূরণের জন্য বনায়ন
প্রয়োজন। কিন্তু দেশের আবহাওয়া ও মাটির উপযোগিতার কথা চিন্তা না করে এমন সব গাছ
রোপন করা হয় যা পরবর্তীতে মাটির উর্বরতা শক্তিকে ধাংস করে ভবিষ্যৎ বনভূমি
সৃষ্টিতে বাধা দেয়, ফলে বনভূমি ক্রমশ বিরানভূমিতে পরিণত হয়।
(১০) পশুচারণঃ বনভূমির ভেতরে ও বাইরে গবাদি পশুর নির্বিচার চারণের ফলে
গবাদি পশুগুলো ছোট ছোট চারা বিনষ্ট করে এবং গাছ খেয়ে ফেলে যা বনভূমি ধ্বংসের
অন্যতম কারণ।
(১১) রোগ-ব্যাধিঃ রোগ-ব্যাধি বেশী দেখা দেয় মনোকালচার করা বনভূমিতে।
সেখানো কোনো মহামারি বা পেস্টের আক্রমণ হলে তা দমন করা কষ্টকর। কিন্তু
মিশ্রকালচার করা বনে অসংখ্য ধরনের গাছ থাকে এবং তাতে অসংখ্য ধরনের প্রাণী বাস করে
যা খাদ্য-খাদক সম্পর্কে সম্পর্কিত। ফলে প্রাকৃতিক উপায়ে রোগের জৈবনিক নিয়ন্ত্রণ
সম্ভব হয়।
(১২) দাবানলঃ দাবানলে ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বনভূমি আজ ধ্বংসের কবলে
পতিত হয়েছে।
(১৩) ঝুম চাষঃ বিভিন্ন দেশে পাহাড়ী অধিবাসীরা পাহাড়ে ঝুম পদ্ধতিতে চাষাবাদ
করে। এর ফলে পাহাড়ে বনভূমি সৃষ্টি করা কষ্টকর বা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এভাবে, বনভূমি
ধ্বংস হয়।
(১৪) ঝড়-তুফানঃ প্রচন্ড ঝড়েও বনভূমি আলোড়িত ও বিনষ্ট হয়। বাংলাদেশের উপর
দিয়ে ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ৩৬টি বিধ্বংসী ঝড় বয়ে গেছে। এগুলো কোনোটা
চট্টগ্রামের বনাঞ্চল, কোনোটা সুন্দরবনের দারুণ ক্ষতি করেছে। সেই ক্ষতি কাটিয়ে
উঠতেই আবার ঝড় এসে হানা দেয়। এভাবে, উপকূলীয় দেশগুলোর বনভূমি সব সময় হুমকির
মুখোমুখি থাকে।
(১৫) মরুকরণঃ বনভূমির কোনো অংশে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হলে তা প্রতিরোধের
ব্যবস্থা না নেয়া হলো ক্রমশ অন্যান্য অংশও ধ্বংস হয়ে যায়।
(১৬) বন্যপ্রাণী সংরক্ষণঃ প্রায় প্রত্যেক বনেই প্রকৃতিদত্ত এমন কিছু
হিংস্র জন্তু থাকে যার মুখোমুখি হতে মানুষ ভয় পায়। এভাবে, বন সংরক্ষিত থাকে।
সংরক্ষণের অভাবে এসব জন্তু নিশ্চিহ্ন হলে সেই বনভূমিরও স্থায়িত্ব কমে যায়। বাঘের
জন্যই বাংলাদেশে এখনও সুন্দরবন টিকে আছে।
বনভূমি ধ্বংসের ফলাফল
(১) বনভূমির গাছ পোড়ানোর ফলে প্রতিবছর বায়ুমণ্ডলে ২০-২৫% CO2 যোগ হয়ে
পরিবেশ দূষিত করে।
(২) বনজ্বালানীর CO2 বায়ুমন্ডলে মিশে গ্রীন হাউস
ইফেক্ট সৃষ্টি করে।
(৩) বনভূমি পৃথিবীর 'ফুসফুস' এর মতো। এগুলো সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় CO2
ব্যবহার করে পরিবেশ নির্মল রাখে। কিন্তু ধ্বংস হয়ে গেলে বা পোড়ানোর ফলে তা থেকে
বরং বাড়তি CO2 পরিবেশে যোগ হয় এবং এর পাতাগুলো পর্যন্ত মাটির উর্বরতা
বাড়ানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
(৪) ভূমিক্ষয়ের প্রবণতা বাড়ে, ফলে খরা ও মরুকরণ ত্বরান্বিত হয়।
(৫) ক্ষয়িত ভূমি পারিবাহিত হয়ে নদী ও হ্রদের নাব্যতা কমিয়ে দেয়। হিমালয়ের পাহাড়ী
পাদদেশ থেকে বাহিত মাটিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় বন্যার
প্রচণ্ডতা বেড়েছে।
(৬) বনভূমি ধ্বংসের ফলে বনের অধিবাসীরা বাস্তুচ্যুত হয়।
(৭) আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন ঘটে।
(৮) ভূগর্ভস্থ পানিস্তর নিচে নেমে যায়।
(৯) বন্যপ্রাণিরা বসতি হারিয়ে বিলুপ্তির পথে পা পাড়ায়।
(১০) অর্থনৈতিক ও ওষধীগুরুত্বপূর্ণ গাছ হারিয়ে যায়।
(১২) উপকূলীয় অঞ্চলে ঝড়ের তাণ্ডব বেশী অনুভূত হয়।
(১১) বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যকারী খাদ্যশৃংখল ও খাদ্যজাল ছিন্ন হয়ে জীবজগতে
বিপর্যয় ঘটায়।
(১৩) বনভুমি ধ্বংসের ফলে একটি দেশর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিলিন হয়ে সৌন্দর্যহীন হয়ে
যায়। ফলে পর্যটন শিল্পও বিপর্যস্ত হয়।
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url