যানজট সমস্যা ও তার প্রতিকার

যানজট সমস্যা আমাদের দেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরে পরিচিত একটি সমস্যা। ঢাকা শহরের মানুষদেরকে প্রতিদিন এই সমস্যার মধ্য দিয়েই জীবন যাপন করতে হয়।
যানজট সমস্যা ও তার প্রতিকার
সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য যত দ্রুত সম্ভব এই যানজট সমস্যা নিরঃসন করা প্রয়োজন।

সূচিপত্রঃ-

ভূমিকা

যানজট আমাদের জীবনে অভিশাপেরই নামান্তর। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে মহানগরীগুলোতে যানজট প্রতিদিনের ভোগান্তির আরেক নাম। যানজটের কারণে সাধারণ মানুষ সময়মতো কর্মস্থলে যেতে পারছে না। শিক্ষার্থীরা সময়মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারছে না। অনেক সময় যানজটের কারণে অসুস্থ রোগীকে ঠিক সময়ে হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না; ফলে রাস্তাতেই সে মৃত্যুবরণ করে।
আবার যনজটে আটকে থেকে চালক তার মানসিক ধৈর্য হারিয়ে সুযোগ পাওয়া মাত্রই বিকল্প পথে অথবা ভিড়ের মধ্যেই দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছে; ফলে প্রায় ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনা ঘটছে। এভাবে যানজটের ফলে প্রতিদিনই বিভিন্ন ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে মানুষ। যানজটে তাদের মানসিক স্থিতি নষ্ট হয়ে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিচ্ছে।

যানজটের স্বরূপ

সাধারণভাবে যানজট বলতে আমরা বুঝি রাস্তায় যানবাহনের স্থবিরতাকে। বিভিন্ন কারণে সড়ক বা মহাসড়কে যখন যানবাহন স্থবির হয়ে পড়ে, তখন যানজটের সৃষ্টি হয়। এই স্থবিরতা মানুষের কারণে বা যান্ত্রিক কারণেও সংঘটিত হতে পারে। তবে দুটি কারণের পেছনেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের বিবেচনাবোধ দায়ী। তাছাড়া আমাদের দেশের সড়ক ও মহাসড়কগুলোর বেহাল দশার কারণেও যানজট সংঘটিত হয়। অনেক সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সড়ক বা মহাসড়কে বিপত্তির সৃষ্টি হয়েও যানজট সৃষ্টি হয়। রাস্তায় কর্তব্যরত ব্যক্তিদের কর্তব্যে অবহেলা ও অদূরদর্শিতার ফলেও যানজট সৃষ্টি হয়। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের চলাচলের আগে দ্রুত রাস্তা ফাঁকা করা হয়। এ কারণে তাড়াহুড়ো করতে গিয়েও যানজট সৃষ্টি হয়।

বহির্বিশ্বে যানজট

শিল্প ও টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের প্রায় সবদেশেই তৈরি হয়েছে সড়ক-মহাসড়ক। সেখানে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত চলছে হাজার হাজার যানবাহন। তাই তারাও যানজট থেকে একবারে মুক্ত নয়। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যানজট সমস্যা কিছুটা হলেও বিদ্যমান; কিন্তু তা সহনীয় পর্যায়ে আছে। তবে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে যানজট সমস্যা নেই বললেই চলে। তাদের রাস্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত আধুনিক; সে কারণে তারা ওই ধরনের সমস্যা থেকে মুক্ত।
যানজট যাতে না হয় সে কারণে তাদের অভিনব সব পরিকল্পনা রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশেই প্রাইভেট কার চালানোর নীতিমালা রয়েছে। জোড় ও বিজোড় রেজিস্ট্রেশনের গাড়ি সেখানে সপ্তাহের ভিন্ন ভিন্ন দিনে চালানো হয়। মাত্র তিন দশক আগেও আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মুম্বাই, দিল্লি ও কলকাতার মতো মহানগরীতে ভয়াবহ যানজট ছিল। কিন্তু তাদের অভিনব সব কৌশল ও অক্লান্ত পরিশ্রমে সেসব স্থানে যানজট প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌছে গেছে।

বাংলাদেশে যানজটের প্রকৃত চিত্র

কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশে যানজটের এমন ভয়াবহ চিত্র ছিল না। দ্রুত নগরায়ণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়নের ফলে যানজট আজ জেঁকে বসেছে। তবে ভিন্ন চিত্র মফস্বল, থানা ও ছোটো শহরগুলোর; সেখানে যানজট নেই বললেই চলে। শুধু মেট্রোপলিটন ও বিভাগীয় শহরগুলোতে যানজটের আধিক্য লক্ষ করা যায়; তন্মধ্যে ঢাকা শহরের যানজটই মুখ্য।
যানজট সমস্যা ও তার প্রতিকার
প্রতিনিয়তই ঢাকা শহরে হাজার হাজার কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। লন্ডনভিত্তিক ইকোনমিস্ট পত্রিকার জরিপ অনুসারে বিশ্বের ১৪০টি নগরীর মধ্যে যানজটের দিক থেকে ঢাকার অবস্থান ১৩৯তম। সে কারণে সকাল ৯টায় অফিসে পৌছার কথা থাকলেও মানুষ হয়তো পৌঁছচ্ছে তারও এক ঘণ্টা পর। তাছাড়া গ্রাম থেকে কাজের খোঁজে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতাও যানজটের অন্যতম কারণ। অন্তত এ কারণেই ঢাকা শহরে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।

যানজটের প্রকৃত কারণ

যানজটের বহুবিধ কারণ রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ হলো-

(ক) অপরিকল্পিত নগরায়ণঃ

বাংলাদেশের সর্বত্র নগরায়ণের ছোঁয়া লেগেছে; সর্বত্রই ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে দালানকোঠা। ঢাকা শহরকে দেখে আর সবুজ সুশ্রী বলে মনে হয় না। এই নগরায়ণের ধাক্কায় শহর থেকে মানুষ আস্তে আস্তে নগরমুখী হচ্ছে। ফলে মানুষের চাপ বাড়ছে শহরে।
আর এ অতিরিক্ত মানুষের চাপ সামলানোর জন্য প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে গণপরিবহণ, যা রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। এ কারণে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। তাছাড়া দালানকোঠা করতে রাস্তার যত্রতত্র ফেলে রাখা হচ্ছে নির্মাণসামগ্রী। তার ফলেও যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।

(খ) রাস্তা মেরামতের কাজ ও ফুটপাথের অপব্যবহারঃ

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানেই সারা বছর রাস্তা মেরামতের কাজ করা হয়। ফলে রাস্তার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ কমে যাওয়ায় বা তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যানজটের সৃষ্টি হয়। এছাড়া একশ্রেণির ব্যবসায়ী ফুটপাথ দখল করে তাদের পণ্যের পসরা সাজায়। তাতে পথচারী চলাচল বিঘ্নিত হয় এবং তারা মহাসড়কে নেমে আসে; ফলে যানজট সৃষ্টি হয়।

(গ) চালকের অদক্ষতা ও বড়ো রাস্তায় ছোটো যানবাহনের উপস্থিতিঃ

আমাদের দেশের বেশিরভাগ চালকই অদক্ষ। তাদের অদক্ষতার কারণে রাস্তায় প্রতিনিয়ত নানা দুর্ঘটনা ঘটে এবং যানজটের সৃষ্টি হয়। এছাড়া কম গতিসম্পন্ন ছোটো যানবাহন মহাসড়কে ঢুকে পড়লেও যানজটের সৃষ্টি হয়।

(ঘ) ট্রাফিক ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা ও অপ্রতুল রাস্তাঃ

রাজধানী ঢাকাতেই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার অদক্ষতার কারণে প্রতিদিন অবর্ণনীয় যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে ঈদের সময় ঢাকায় ঢুকতে ও বেরোতে সীমাহীন যানজটের সম্মুখীন হয় সাধারণ যাত্রীরা। এ সময় ট্রাফিক ব্যবস্থা যেমন ভেঙে পড়ে, তেমনি রাস্তার অপ্রতুলতাও যানজটের সৃষ্টি করে।

(ঙ) জনসাধারণের উদাসীনতাঃ

আমাদের দেশের মানুষ রাস্তায় চলাচলের নিয়ম জানে না বললেই চলে। তাই ফুটপাত, ওভার ব্রিজ বা জেব্রাক্রসিং কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সে জ্ঞান তাদের নেই। তাই গতিশীল রাস্তায় নেমে তারা যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে এবং সেখান থেকে যানজটের সৃষ্টি হয়।

(চ) আইন প্রয়োগে শিথিলতাঃ

রাস্তায় আইন প্রয়োগের শিথিলতাও যানজটের জন্য দায়ী। আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত না হওয়ার কারণে রাস্তায় যারা অনিয়ম করছে তারা সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার আইন জেনেও তা লঙ্ঘন করছে; সে কারণেও রাস্তায় নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে এবং যানজট তৈরি হচ্ছে।

যানজট প্রতিকারের উপায়ঃ

যেভাবে আমাদের দেশের মহানগরগুলোতে যানজট বাড়ছে তাতে কিছুদিন পর রাস্তায় বেরোনোই মুশকিল হয়ে পড়বে। ঢাকা শহরের রাস্তায় বেরোলে প্রাইভেট কারের ছড়াছড়ি লক্ষ করা যায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ঢাকার রাস্তায় যে গাড়ি চলে তার ৮০ ভাগই প্রাইভেট কার।
আর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় গত দশ বছরে ঢাকা শহরে প্রায় আড়াই লক্ষ নতুন প্রাইভেট কার নেমেছে। এর ফলে সৃষ্ট যানজটে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে এবং নষ্ট হচ্ছে ৩২ লক্ষ কর্মঘণ্টা। এই অবস্থা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে সমস্ত দেশে। তাই সর্বোচ্চ গুরুত্বের ভিত্তিতে যানজট প্রতিকারে আমাদের করণীয় হলো-
(১) যানজট নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও সে অনুযায়ী কর্মপদ্ধতি গ্রহণ।
(২) প্রাইভেট কারের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও নতুন গাড়ির জন্য কঠোর শর্ত আরোপ; সে সঙ্গে মানসম্মত গণপরিবহণ নিশ্চিত করা।
(৩) অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে ফুটপাত দখলমুক্ত করা।
(৪) রাস্তার সংখ্যা বাড়ানো ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক ফ্লাইওভার তৈরি করা।
(৫) রেলক্রসিংগুলোতে ওভার ব্রিজ তৈরি করা।
(৬) সকল গাড়ি চালককে ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করা ও আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা।
(৭) ক্ষতিগ্রস্ত ফুটপাথ ও রাস্তাগুলোকে দ্রুত মেরামত করা।
(৮) রিশার জন্য আলাদা লেন তৈরি করা ও যানজট প্রবণ এলাকাগুলোতে একমুখী সড়ক স্থাপন করা।
(৯) ফিটনেস বিহীন যানবাহন ও লাইসেন্স বিহীন চালকদের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
(১০) ট্রাফিক ব্যবস্থা আধুনিক করা এবং সর্বক্ষেত্রে রাস্তায় যানবাহন চলাচলের বিষয়টি মনিটর করা।
উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণের মাধ্যমে যানজট থেকে অনেকাংশেই পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

উপসংহার

যানজট সমস্যা ঢাকাসহ দেশের প্রায় সর্বত্রই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। যানজটের কারণে জরুরি সেবার (অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার বিগ্রেড ইত্যাদি) গাড়িগুলো পর্যন্ত সেবা নিশ্চিত করতে পারছে না। ফলে নানারকম দুর্ঘটনার সৃষ্টি হচ্ছে। এসব কারণে সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে; যা আমাদের দেশের বাস্তবিক প্রেক্ষাপটের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ কারণে ভয়াবহ যানজট থেকে জীবন, সময় ও সম্পদ রক্ষা করা বর্তমানে জরুরি হয়ে পড়েছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url