কম্পিউটার বিজ্ঞানের বিস্ময়
বিজ্ঞান যুগে যুগে তার কল্যাণে অনেক অভাবনীয় প্রযুক্তির সাথে মানুষের পরিচয় করিয়েছে।
সেই উদ্ভাবন গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো কম্পিউটার। কম্পিউটারের শাব্দিক
অর্থ হিসাবকারী যন্ত্র। সভ্যতা হলো মানব জাতির বুদ্ধি, মেধা ও অভিজ্ঞতার সমষ্টি। বিংশ শতাব্দীতে
একক আবিষ্কার হিসেবে কম্পিউটার মানবজীবনকে যতটা প্রভাবিত করেছে, তা সম্ভবত অন্য
কোন আবিষ্কার করতে পারেনি। কম্পিউটারে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মস্তিষ্কের অনুকরণ
করা হয়েছে। তবে কাজের দ্রুততা, বিশুদ্ধতা এবং নির্ভরশীলতার দিক থেকে কম্পিউটার
মানুষের চেয়ে অনেক উন্নত। আধুনিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই কম্পিউটারের
নিয়ন্ত্রণাধীন।
সূচিপত্রঃ- কম্পিউটার বিজ্ঞানের বিস্ময়
ভূমিকা
আধুনিক যুগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। এ যুগে বিজ্ঞানকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো
সুযোগ নেই। ব্যক্তি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে
গেছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে আধুনিক সভ্য জগৎ এখন অকল্পনীয়। আর বিজ্ঞানের
আরেক অকল্পনীয় দান হচ্ছে কম্পিউটার। বিশ শতকে একক আবিষ্কার হিসেবে কম্পিউটার
মানব জাতিকে যতটা প্রভাবিত করতে পেরেছে, মানুষের জীবনকে যতটা গতিসম্পন্ন করতে
পেরেছে, তা বোধ করি অন্য কোনো আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়নি। বিজ্ঞানের নানা
আবিষ্কার নানা ক্ষেত্রে যুগান্তকারী বিপ্লব বয়ে আনলেও কম্পিউটারই আজ বিজ্ঞানের
বিস্ময় হিসেবে বিবেচিত।
কম্পিউটারের ধারণা
ল্যাটিন শব্দ 'কম্পিউট' (Compute) থেকে কম্পিউটার শব্দটির উদ্ভব। কম্পিউটারকে
এক অর্থে যন্ত্র মস্তিষ্ক বলা যায়। এটি এমন একটি যন্ত্র যা অগণিত উপাত্ত ও তথ্য
গ্রহণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ করে দ্রুত সিদ্ধান্ত দিতে পারে। মানুষ
যেমনভাবে তার স্মৃতিতে তথ্য ধরে রাখে, তেমনি কম্পিউটারও তার স্মৃতি বা মেমোরিতে
তথ্য ধরে রাখে। কম্পিউটারে রয়েছে তিনটি সুস্পষ্ট অংশ ১. সেন্ট্রাল প্রসেসিং
ইউনিট, ২. ইনপুট ও ৩. আউটপুট। কম্পিউটার যেসব তথ্য নিয়ে কাজ করে তাকে ডেটা বলে;
আর যে ক্রমবিন্যাস পদ্ধতিতে কাজ করে তাকে বলে প্রোগ্রাম। কম্পিউটারের
নির্ভুলভাবে কাজ করার পেছনে রয়েছে বিশেষ বিশেষ কিছু পদ্ধতি- অত্যন্ত দ্রুত গণনা
করার ক্ষমতা, বিপুল পরিমাণ উপাত্তকে স্মৃতিতে ধরে রাখার ক্ষমতা; তথ্য
বিশ্লেষণের নির্ভুল ক্ষমতা; প্রোগ্রাম অনুসারে কাজ করার ক্ষমতা।
ইতিহাস ও বিবর্তন
গণিতবিদ চার্লস ব্যাবেজ (১৭৯২-১৮৭১)-কে কম্পিউটার সৃষ্টির জনক বলা হয়। ১৮৩৩
সালে ব্যাবেজ 'এনালিটিক্যাল ইঞ্জিন' নামক গণনা যন্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করেন।
ব্যাবেজ যে পাঁচটি ভাগে (স্টোর, মিল, কন্ট্রোল, ইনপুট, আউটপুট) কম্পিউটার তৈরির
পরিকল্পনা করেছিলেন তার ওপর ভিত্তি করেই ১৯৬৪ সালে 'ইনিয়াক' নামক প্রথম
কম্পিউটার আবিষ্কৃত হয়। জন ভন নিউম্যানকে কম্পিউটারের জনক বলা হয় তবে কম্পিউটার
আবিষ্কার করেন হাওয়ার্ড এইচ, আইকেন। তবে বর্তমানকালে এগুলো শুধুই ইতিহাস;
বাজারে যষ্ঠ প্রজন্মের কম্পিউটারের আগমন ঘটেছে আর সপ্তম প্রজন্মের কম্পিউটার
আসার প্রতীক্ষায় রয়েছে। তবে সাধারণভাবে আমরা যেকোনো ইলেকট্রিক জিনিসের যদি
(Computer Electronics) লেখা দেখি তবে বুঝতে হবে সেটি কোনো না কোনোভাবে
কম্পিউটারের প্রভাবজাত।
কম্পিউটারের প্রকারভেদ
কম্পিউটারের আকৃতি, কার্যসম্পাদনের গতি ও প্রক্রিয়া অনুযায়ী নানারকম কম্পিউটার
দেখা যায়। যেমন- সুপার কম্পিউটার, মিনি কম্পিউটার, মাইক্রো কম্পিউটার,
মেইনফ্রেম ইত্যাদি। অধুনা ল্যাপটপ কম্পিউটার বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। সহজে
পরিবহণ এবং কাজের সুবিধার জন্য এই কম্পিউটারই অনেকের কাছে এখন আকর্ষণীয় এবং
কাম্য।
কম্পিউটারের ব্যবহার
কম্পিউটার মানবজীবনের সাথে এখন এত ব্যাপক পরিসরে সম্পৃক্ত হয়েছে যে,
কম্পিউটারকে এখন মানুষের অনিবার্য সঙ্গী হিসেবে কল্পনা করা যায়।
ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, মহাকাশ গবেষণা প্রভৃতি ক্ষেত্রে কম্পিউটার
আজকাল অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও কম্পিউটার ব্যবহৃত হচ্ছে
ব্যাপকভাবে। ই-মেইল, ইন্টারনেট তথা আধুনিক দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায়
কম্পিউটারই প্রধান সহায়ক। মানবজীবনের সকল স্তরকে যেন কম্পিউটার জয় করে ছাড়বে।
দেশের অফিস-আদালত, কলকারখানা সর্বত্রই কম্পিউটারের উপস্থিতি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ
বিশ্লেষণ, বাজেট প্রণয়ন ইত্যাদি কাজেও কম্পিউটারের ব্যবহার দিন দিন নবযাত্রা
লাভ করছে। মোটকথা, কম্পিউটার ও মানবজীবন এখন অভিন্ন। একটিকে বাদ দিলে যেন
অন্যটি বিকল।
কম্পিউটারের নবযাত্রা
যেদিন কম্পিউটার প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল সেদিনকার আকৃতি এখন আর নেই বললেই চলে।
আকৃতিতে কম্পিউটার এখন অনেক ছোটো হয়েছে কিন্তু কাজের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
কম্পিউটারে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন প্রতিভার অবদান। দিন যত যাচ্ছে ততই কম্পিউটার
তার ক্ষমতাকে যেন বৃদ্ধি করে চলেছে। মানুষের সকল কাজই যেন সে একা করবে। তাই
ক্রমশ কাজের ক্ষেত্রে কম্পিউটার শক্তিমান হয়ে উঠছে। কোন কম্পিউটার কত দ্রুত কত
কাজ করতে পারে এর ওপর নির্ভর করছে তার চাহিদা। তাই কম্পিউটার কোম্পানিগুলোও বড়ো
বড়ো বিজ্ঞানী ও গবেষকের মাধ্যমে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার শীর্ষে থাকার
চেষ্টা করছে, ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে কম্পিউটারের কার্য সম্পাদনের ক্ষমতা।
বাংলাদেশে কম্পিউটার
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কম্পিউটার ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অফিস,
আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্রই এখন কম্পিউটার। কম্পিউটারে পারদর্শী হলে
তুলনামূলকভাবে ভালো কর্মসংস্থান জোটে বলে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে কম্পিউটার এখন
জনপ্রিয়। কম্পিউটারের ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ
বিদ্যাপীঠে এখন কম্পিউটার বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির প্রচলন হয়েছে।
এমনকি কম্পিউটার তথা বিজ্ঞাননির্ভর পড়াশোনার বিস্তারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
বিশ্ববিদ্যালয় নামে পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। দেশ-বিদেশে সর্বত্র
মুদ্রণশিল্পে কম্পিউটারের অনিবার্যতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তাই বলা যায়,
কম্পিউটার বিজ্ঞানের এমন দান যে, তাকে দু হাত ভরে গ্রহণ না করার কোনো সুযোগ
নেই।
কম্পিউটার ও শিক্ষা
বর্তমান সময়ের প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সবস্থানেই কম্পিউটার বিষয়ে পড়ানো
হচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় কম্পিউটার বিষয় হিসেবে যেমন পড়ানো হচ্ছে,
তেমনি উচ্চশিক্ষায় কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করা হচ্ছে। তাছাড়া
কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়ে দেশে কম্পিউটার বিষয়ের প্রকৌশলী সৃষ্টি হচ্ছে,
যারা বিভিন্ন পর্যায়ে কম্পিউটার বিষয়ে উচ্চতর দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। দেশেই
সৃষ্টি হচ্ছে নানা ধরনের কম্পিউটার ফার্ম, যারা কম্পিউটারের মানোন্নয়ন ও এর
ব্যবহারকে আরও প্রসারিত করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে।
কম্পিউটার ও শিল্পবাণিজ্য
শিল্প ও বাণিজ্যে কম্পিউটার ব্যবহার বহু বহু কর্মঘন্টা ও পরিশ্রমকে সাশ্রয়
করেছে। অটোমেশনের ফলে ভারী ভারী অনেক কাজও সহজ হয়ে গেছে। বন্দরগুলোতে ডিজিটাল
সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে, ফলে পণ্য খালাসেও নতুন গতি সঞ্চার হয়েছে। পোশাক
কারখানা ও দেশীয় ইলেকট্রনিকস্ কারখানায় কম্পিউটার চালিত বড়ো বড়ো রোবট ব্যবহার
করে কাজে নতুন গতি সঞ্চার করা হয়েছে। শিল্পের সমস্ত পর্যায়ে কম্পিউটার দিয়েছে
নতুন গতি নতুন প্রাণ। বাংলাদেশে বর্তমানে শিল্প ও বাণিজ্যের কোনো সেক্টরই
কম্পিউটারের বাইরে নয়।
কম্পিউটার ও কৃষি
বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ; তাই কৃষিতে কম্পিউটারের ব্যবহার ব্যাপকভাবে
বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আর পরীক্ষা ছাড়া কৃষক মাটিতে সার ও কীটনাশক দেয় না। জমির
উর্বরতাও এখন কম্পিউটার মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়। তাছাড়া কম্পিউটারের সাহায্যে
আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা সম্ভব হয় বলেই কৃষক তার ফসলকে রক্ষা করার সুযোগ পায়।
গবেষণাগারে কম্পিউটারের মাধ্যমে গবেষণা করেই নতুন নতুন উন্নত ফসলের জাত উদ্ভাবন
করা সম্ভব হচ্ছে। আর সেগুলো মাটিতে বপন করেই কৃষক ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করছে।
পরোক্ষভাবে কম্পিউটারের সাহায্য নিয়েই কৃষক তার ফসল বিদেশে রপ্তানি করছে।
কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়া
হাজার উপকারিতা সত্ত্বেও কম্পিউটারের কিছু অপকারিতা নিয়ে সমালোচনাও আছে। যুদ্ধ-
বিগ্রহ, অস্ত্র নির্মাণ ইত্যাদিকে সহজ করে তুলছে কম্পিউটার। দশ জনের কাজ এখন
কম্পিউটার একাই করতে পারে বলে এটাও কম্পিউটারের দোষ বলা হয়ে থাকে। কেননা, এতে
বেকারত্বের সৃষ্টি হচ্ছে।
উপসংহার
গুহাবাসী মানুষ আজ বিশ্বজয় করেছে আর বিশ্বকে জয় করেছে কম্পিউটার। বিজ্ঞানের
হাজার আবিষ্কারের মধ্যে কম্পিউটারই শক্তিমান। তাই কম্পিউটার বিজ্ঞানের বিস্ময়,
বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ দান।
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url