শিশুর পরিপূরক খাবার কি - পরিপূরক খাবারের প্রয়োজনীয়তা

শিশুর পরিপূরক খাবার বাচ্চার বয়স অনুযায়ী খাওয়ানো উচিত। শিশুর ৬ মাস বয়স পূর্ণ হওয়ার পর বুকের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক খাবারের প্রয়োজন। কারণ ৬ মাস বয়সের পর বাড়ন্ত শিশুর পুষ্টি ও বিকাশের জন্য সুষম খাদ্য উপাদান বিশিষ্ট খাবারের প্রয়োজন। 
পরিপূরক খাদ্যের ৫টি বৈশিষ্ট্য কি কি?
মায়ের দুধ সে প্রয়োজন মিটাতে যথেষ্ট নয়। তাই বুকের দুধের পাশাপাশি শিশুকে পরিপূরক খাবার দেয়া দরকার।

মূচিপত্রঃ- শিশুর পরিপূরক খাবার কি ও পরিপূরক খাবারের প্রয়োজনীয়তা

শিশুর পরিপূরক খাবার কিঃ

শিশুর ৬ মাস বয়স পূর্ণ হওয়ার পর বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য যে সকল খাবার শিশুকে খাওয়ানো হয় সে গুলোই পরিপূরক খাবার। কারণ শিশুর পুষ্টি ও মানুষিক বিকাশের জন্য মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি সুষম খাদ্য উপাদান বিশিষ্ট খাবারের প্রয়োজন। ছোট শিশু একবারে বেশী করে খেতে পারে না। তাই তাদেরকে বারে বারে অল্প করে খাবার দিতে হবে। কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে যেন খাবারে অতিরিক্ত পানি না থাকে। বিভিন্ন ধরনের খাবার হলে শিশু ভালভাবে গ্রহণ করবে এবং একঘেয়ে লাগবে না। শিশুর খাবার শক্তি বৃদ্ধিকারক হওয়া উচিৎ।

পরিপূরক খাবারের প্রয়োজনীয়তাঃ

শিশুর বয়স বাড়ার সাথে সাথে পরিপূরক খাদ্য খাওয়ানো প্রয়োজন। শিশুর শারীরিক ও মানুষিক বৃদ্ধিতে পরিপূরক খাদ্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
  • শিশুর দেহের বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণের জন্য তার বাড়তি আমিষের প্রয়োজন।
  • খাদ্যের গুনগতমান রক্ষার জন্য উদ্ভিজ আমিষের সাথে কিছু পরিমানে প্রানিজ আমিষ থাকা দরকার। কেননা প্রাণিজ আমিষ শরীরের কাজে বেশী লাগে।
  • শিশুর ক্যালরী বা শক্তির চাহিদা বড়দের চেয়ে ২-৩ গুণ বেশী। তবে এটা দেহের ওজনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আবার আমিষকে শরীরের কাজে লাগাতে শক্তির প্রয়োজন। কেননা খাবারে ক্যালরীর অভাব হলে আমিষ নিজে শরীরে শক্তি বা ক্যালরী জোগাড় করে।
  • শিশুর কাছে পরিপূরক খাবারের স্বাদ নতুন বলে প্রথম সে খেতে নাও পারে, তাই তাকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় নরম করে খুব অল্প পরিমানে বারে বারে খাওয়াতে হবে।
  • পরিপূরক খাবার না দিলে তার দেহে নানা প্রকার পুষ্টিহীনতা যেমন- রক্তস্বল্পতা, শর্করা ও আমিষের অভাব, ভিটামিন-সি এর অভাবে স্কার্ভি, ভিটামিন- ডি এর অভাবে রিকেট, ভিটামিন 'এ' এর অভাবে রাতকানা ইত্যাদি অপুষ্টি জনিত রোগ দেখা দিতে পারে।

শিশুকে নতুন খাবার দিতে হলে যে বিষয় গুলো খেয়াল রাখবেনঃ

শিশুকে নতুন খাবার দিতে হলে কতকগুলো বিশেষ দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে, যেমন-
  • শিশুর শারীরিক অবস্থা, বয়স, ওজন ইত্যাদি।
  • খাবারগুলো এমনভাবে নির্বাচন করতে হবে যেন সহজপাচ্য, আকর্ষণীয় ও পুষ্টিমান সম্পন্ন ও সহজ লভ্য হয়। শিশুর ওজন ৬ মাস বয়সে জন্মের ওজনের দ্বিগুন হতে হবে।
  • শিশুকে সাধারণতঃ বাবা মায়ের সংগে বসিয়ে খাওয়াতে হবে। ফলে সে খাবার খেতে উৎসাহ পাবে।
পরিপূরক খাবার কখন খাওয়া উচিত?
  • শিশু নুতন খাবার কতটা হজম করতে পারলো তা বোঝা যাবে তার মল দেখে ও ওজন বৃদ্ধির রেকর্ড থেকে (শিশুর ক্রমবৃদ্ধির চার্ট বা কার্ড এর মাধ্যমে)।
  • শিশুকে কোন খাবার গ্রহনের জন্য জবরদস্তি করা যাবে না। শিশু ক্ষুধার্ত হলে আপনা আপনি খাবে।

৬ মাস পূর্ণ হলে যে খাবার খাওয়তে হবেঃ

৬ মাস পূর্ণ হওয়ার পর (পূর্ণ ৬ মাস) বয়স থেকে বুকের দুধের সংগে সংগে যে সমস্ত খাবার পরিপূরক হিসাবে শিশুর জন্য প্রযোজ্য সেসব খাবারের কিছু কিছু উলে-খ করা হলোঃ-
১. আলু সিদ্ধ ও ডাল চটকিয়ে
২. ডালে বা দুধে ভেজানো রুটি
৩. ফলের রস ও চটকানো ফল (দেশীয় ফল- যেমন কলা, পেঁপে, কাঁঠাল, পেয়ারা, আম, আনারস)'
৪. দুধের পায়েস বা দুধ দিয়ে রান্না করা সুজি।
৫. নরম সিদ্ধ ডিম।
৬. ভাত, মুড়ি, চিড়া, দুধ দিয়ে নরম করে মেখে।
৭. শাক-সবজি চাল, ডাল ও তেল দিয়ে নরম খিচুড়ী রান্না করে।
৮. টমেটো, মটরশুটি, ফুলকপি, সীম ও অন্যান্য শাকসবজি ভাল করে সিদ্ধ করে চটকিয়ে।
৯. পরিবারের স্বাভাবিক খাবার, কিন্তু তাতে ঝাল ও মসলা কম হতে হবে।
১০. এ সমস্ত খাবারের সাথে রান্না করা মাছও চটকিয়ে দেয়া যায়।

১২ মাস পূর্ণ হলে যে খাবার খাওয়তে হবেঃ

পূর্ণ ১২ মাসের শিশুর জন্য উপরোক্ত খাবার থেকে প্রতিদিন কিছু কিছু নিয়ে নিম্নোক্ত পরিমানে অন্ততঃ ৫- ৭ বার খাওয়ানো যেতে পারে।
খাদ্য সামগ্রী পরিমান
চাল ৬০ গ্রাম (এক মুষ্টি)
ডাল ৩০ গ্রাম (আধা মুষ্টি)
আলু, শাক (পালং, পুঁই, লালশাক ইত্যাদি যে কোন ১টি) ৩০ গ্রাম (আধা মুষ্টি)
সবজির স্যুপ (কাঁচা পেঁপে, পটল, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, ঝিঙা, কাঁচাকলা ইত্যাদি ৪০ গ্রাম (আধা মুষ্টি)
মাছ, মাংস, ডিম (যে কোন একটা) ১৫ গ্রাম (এক টুকরা)
চিনি বা গুড় ৩০ গ্রাম (আধা মুষ্টি)
রান্নার তেল ১০ গ্রাম (অল্প করে)
ফলের রস (যেমন- জামবুরা বা লেবুর রস শরবত করে, কমলার রস, টমেটোর রস ইত্যাদি) ৩০ গ্রাম (আধা গ্লাস বা এক কাপ)
সবজির স্যুপ প্রস্তুত প্রনালীঃ
  • সবজিগুলো প্রথমে ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে।
  • তারপর ছোট ছোট টুকরা করে কাটতে হবে।
  • পানিতে অল্প পরিমাণ লবন দিয়ে হাঁড়িতে ফুটিয়ে নিতে হবে।
  • সবজি পানিতে ছেড়ে দিতে হবে এবং প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর্যন্ত সিদ্ধ করতে হবে
  • যখন পানিটা রঙিন হয়ে যাবে তখন ১ চামচ তেল দিতে হবে।
তারপরে সবজির এই ঝোল (স্যুপ) ছাকনি দিয়ে ছেঁকে নিয়ে শিশুকে প্রথমে অল্প করে খাওয়াতে হবে ও ক্রমান্বয়ে পরিমানে বাড়িয়ে দিতে হবে।
শিশুর জন্য দুধের পায়েশঃ
উপকরণ পরিমান
সুজি বা সিদ্ধ চালের গুড়া ৬০ গ্রাম (এক মুষ্টি)
দুধ ২৫০ গ্রাম (এক পোয়া)
গুড়/চিনি পরিমান মত
লবণ পরিমান মত
প্রস্তুত প্রণালীঃ
প্রথমে চালের গুড়া বা সুজি অল্প একটু পানিতে ভালো করে ফুটিয়ে নিতে হবে। তারপর তাতে দুধ মিশিয়ে ভাল করে সিদ্ধ করতে হবে। নামাবার আগে গুড় বা চিনি এবং লবণ আর একটু পানিতে মিশিয়ে পাতলা কাপড় দিয়ে ছেঁকে পায়েসে দিতে হবে। প্রথমে অল্প করে ও পরে পরিমাণ বাড়িয়ে শিশুকে খাওয়াতে হবে। দিনে অন্ততঃ ২-৩ বার এ খাবার দেওয়া যেতে পারে।
শিশুর জন্য খিচুড়ী (চাউল, কয়েক রকমের মিশানো ডাল, মিশানো সবজি)
উপকরণ পরিমান
চাল ১৮০ গ্রাম (৩ ছটাক পরিমাণ)
ডাল (মিশানো) ৬০ গ্রাম (১ ছটাক পরিমাণ)
ঋতুকালীন সবজি মিশানো ৬০ গ্রাম (১ ছটাক পরিমাণ)
তেল ১ চামচ (তরকারী চামচ)
লবন পরিমান মত
প্রথমে চাল ও ডাল একত্রে মিশিয়ে ধুতে হবে ও ফুটানো পানিতে নরম করে সিদ্ধ করতে হবে। সবজিগুলো ভাল করে ধুয়ে কেটে নিতে হবে। তারপর চাল ও ডালের মধ্যে সবজি দিয়ে নরম করে সিদ্ধ করতে হবে। এই খিচুড়ী শিশুর বয়সানুপাতে নরম করতে হবে। নামাবার আগে টেবিল চামচের ১ চামচ তেল দিতে হবে। শিশুকে এই খাবার প্রথমে অল্প করে খাওয়াতে হবে ও পরে পরিমাণে বাড়িয়ে দিতে হবে। দিনে অন্ততঃ ২-৩ বার এ খাবার খাওয়াতে হবে।

বার মাস বয়সের মধ্যে শিশুকে বুকের দুধের সাথে সাথে বড়দের সব খাবারের সংগে পরিচিত করতে হবে। যেমন, প্রয়োজনীয় পরিমাণে মাছ, ভাত, রুটি ইত্যাদি। এক থেকে দুই বৎসরের একটি শিশু পূর্ণবয়স্ক লোকের সব খাবারই খেতে পারে।

১-৩ বছরের শিশুর চাহিদা অনুযায়ী সুষম খাদ্য তালিকাঃ

খাদ্য সামগ্রী পরিমান
চাল ১১০ গ্রাম (দুই ছটাক)
গম (রুটি, বিস্কুট, ইত্যাদি) ৬০ গ্রাম (এক ছটাক)
ডাল ৪৫ গ্রাম (প্রায় এক ছটাক)
গোল আলু, মিষ্টি আলু ১০০ গ্রাম (দেড় ছটাক)
শাক (যে কোন) ৬০ গ্রাম (এক ছটাক)
সবজির স্যুপ (যে কোন) ৩০ গ্রাম (আধা ছটাক)
মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি ৩০ গ্রাম (আধা ছটাক)
চিনি বা গুড় (যে কোন) ৩০ গ্রাম (আধা ছটাক)
তেল ১৫ গ্রাম (১/৪ ছটাক)
দুধ ১৮০ গ্রাম (৩ ছটাক)
ফল ৩০ গ্রাম (আধা ছটাক)

শিশুর পরিপূরক খাবারের প্রয়োজনীয় তথ্যঃ

শিশুর বয়স ৬ মাস পূর্ণ হলে শুধুমাত্র বুকের দুধ শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য সম্পূর্ণ চাহিদা মেটাতে পারে না। তাই ছয় মাস বয়সের পরে শিশুকে বুকের দুধের পাশাপাশি সম্পূরক খাদ্য দিতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে শিশুকে বুকের দুধ দু'বছর বয়স পর্যন্ত বন্ধ করা যাবে না। বুকের দুধ আগে খাইয়ে নিয়ে শিশুর চাহিদার বাকি অংশটুকু পরিপূরক খাবার দিয়ে পূরণ করতে হবে। এ সময় শিশুকে দিনে ১-২ বার পরিপূরক খাবার দিতে হবে। ৬-৮ মাস বয়সী শিশুকে দিনে ২-৩ বার ৯-১১ মাস বয়সী শিশুকে দিন ৩-৪ বার এবং ১২-২৪ মাস বয়সী শিশুকে দিনে ৪-৫ বার পরিপূরক খাবার দিতে হবে। শিশুরা একবারে বেশী পরিমাণে খেতে পারে না বলেই তাকে বারে বারে খাওয়াতে হবে।

খিচুড়ী শিশুর জন্য একটি উপাদেয় খাবার। চাল, ডাল, সামান্য তেল এবং লবন দিয়ে খিচুড়ী রান্না করে তাতে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন সবজি, কখনও মাছ, কখনও মাংস দিয়ে মিশিয়ে নরম করে শিশুকে খাওয়াতে হবে। এক বছরের উপরে বয়স হলে রুটি ডাল দিয়ে চটকিয়ে দেয়া যাবে। শিশুকে চালের গুড়া অথবা সুজি রান্না করে খাওয়াতে চাইলে এসব একটু তেল এবং পানি দিয়ে রান্না করে খেতে দেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে শিশুকে আলাদাভাবে ডাল অথবা মাছ করে খাওয়াতে হবে। মনে রাখতে হবে শিশুর বয়স এক বছরের নীচে হলে শিশুকে গরুর দুধ দিয়ে এসব রান্না করে খেতে দেয়া উচিৎ নয়। কেননা দুধের চাহিদা শিশু বুকের দুধ থেকেই মেটাতে সক্ষম। এ ছাড়া বিভিন্ন মৌসুমী ফল নরম করে চটকিয়ে অথবা রস করে শিশুকে দেয়া যেতে পারে।

শিশুকে খাওয়ানোর আগে শিশুর হাত-মুখ ও মায়ের হাত, থালা বাটি চামচ ভালভাবে নিরাপদ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এক বছরের নীচে শিশুকে দিনে রাতে কমপক্ষে আট বার, এক বছর থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত কম পক্ষে পাঁচবার বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। যে কোন খাবারই প্রথমে শুরু করতে হলে অল্প করে কয়েক দিন দিতে হবে। শিশু এতে অভ্যস্ত হলে পরে অন্য খাত্রার শুরু করতে হবে।

৬ মাস বয়সের আগে শিশুকে যে খাবার খাওয়ালে অসুবিধা হতে পারেঃ

৬ মাস বয়সের আগে শিশুকে চালের গুড়া, সুজি অথবা অন্য কোন খাবার দিলে কি কি অসুবিধা হতে পারে-
১. শিশুর এই সময় ভাল হজম হয় না বলে পাতলা পায়খানা হতে পারে।
২. শিশুর অপুষ্টি হতে পারে।
৩. শিশু বুকের দুধ খাওয়া কমিয়ে দিবে এবং বুকের দুধ খাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে।
৪. বুকের দুধ আস্তে আস্তে কমে যাবে।

১ বছর পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাওয়ালে যে সমস্যা হতে পারেঃ

১ বছর পর্যন্ত শুধু মাত্র বুকের দুধ খাওয়ালে শিশুর যে যে সমস্যা হতে পারে-
  • শিশু অপুষ্টিতে ভুগবে।
  • অপুষ্টি জনিত কারণে শিশুর বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকবে।
মনে রাখতে হবেঃ
শিশুকে ৬ মাসের আগেও নয়, আবার বেশী পরেও নয়, ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার পরই মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি শিশুর পরিপূরক খাবার শুরু করার উপযুক্ত সময়।

তথ্যসুত্রঃ (পরিবার কল্যাণ সহকারী এবং পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক) সহায়িকা

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url