ব্যক্তিগত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা কি?-ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা প্রয়োজন

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব অপরিসীম। মুমিনরা সর্বদা তাদের আত্মার পবিত্রতা, শারীরিক পরিচ্ছন্নতা, পোশাক ও পরিবেশের পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হয়। প্রকৃত ঈমানদার হওয়ার জন্য পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা অপরিহার্য। ইসলামে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার অবস্থান ঈমানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। হাদিস শরিফে পবিত্রতাকে ঈমানের অর্ধাংশ বলা হয়েছে। যারা পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে জীবনযাপন করনে আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন।

সূচিপত্রঃ- ব্যক্তিগত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা কি?-ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা প্রয়োজন

ব্যক্তিগত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা কি?

ব্যক্তির শারীরিক পরিচ্ছন্নতাকেই ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বলে।

ব্যক্তিগত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা প্রয়োজনীয়তা কি?

ব্যক্তিগত ভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা থাকা মানুষের জন্য একান্ত অপরিহার্য। কারণ ব্যক্তিগত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। ব্যক্তিগত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখলে ব্যক্তির দাঁত, ত্বক, চুল শারীরিক সুস্থতা বজায় থাকে ফলে আমাশয়, ডায়রিয়া, কৃমি, খুজলী, পাঁচড়া, দাউদ রোগ থেকে রক্ষা পেতে পারে। ফলে রোগাক্রান্ত ব্যক্তি অন্য কাউকে এসব রোগে সংক্রামিত করতে পারে না। নিজেও সুস্থ থাকা যায়।
ব্যক্তিগতভাবে শারীরিক পরিচ্ছন্নতা না থাকলে উপরোলি-খিত রোগগুলোতে মানুষ সহজে আক্রান্ত হয়। অকালে দাঁত, চুল পড়ে যায়। ত্বক নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য ব্যক্তিগতভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা একান্ত আবশ্যক। ব্যক্তির যে কোন কাজকেই আত্মবিশে-যণ দ্বারা পরিমাপ ও পরিশুদ্ধ করা যায়।

আত্মবিশেষণ কি?

আত্মবিশে-ষণ বলতে নিজেকে বা নিজের কাজকে নিম্নলিখিতভাবে বিশে-ষণ করা বুঝায়। যে কোন আত্মবিশেষণ মূলক প্রশ্ন সমূহ নিম্নরূপে হতে পারে। যেমন-
আমি কি দৈনিক দাঁত মাজি উত্তর হ্যাঁ/না হতে পারে। আমি কেন এই কাজ করি, দাঁত ভাল রাখার জন্য এবং শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য দাঁত মাজা সম্বন্ধে আমি অন্যকে যা বলি তা কি আমার বাস্তব জীবনে আমি পালন করি। এখানে আত্মবিশে-ষণ মানুষকে কাজের সঠিক পথ অবলম্বন করতে সাহায্য করে।

ব্যক্তিগত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা কি কি

আঙ্গুলের নখ পরিস্কার রাখাঃ
আঙ্গুলের নখ পরিস্কার না রাখলে নখ বড় হয়। নখের ভিতরে ময়লা জমে। এই ময়লা, খাবারের সময় পেটে যায় এবং খাবার তৈরীর সময় খাবারের মধ্যে মিশে যায়। সেই খাবার খেলে নিজে এবং পরিবারের সবাই ডায়রিয়া, আমাশয় এবং কৃমি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এইসব রোগ হতে বাঁচতে হলে নিয়মিত সপ্তাহে ১ দিন নখ কাটতে হবে। পায়খানা থেকে এসে এবং খাবারের আগে সাবান দিয়ে হাত পরিস্কার রাখতে হবে।
শারীরিক পরিচ্ছন্নতাঃ
শারীরিক পরিচ্ছন্নতা বলতে নিজের শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখাকে বুঝায়। শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। যেমনঃ চুল, মুখ, দাঁত, কান ও নখের যত্ন বোঝায়।
কাপড় পরিস্কার রাখাঃ
পরিধেয় কাপড় প্রতিদিন পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা উচিত। সম্ভব হলে সাবান দিয়ে ধোয়া দরকার। বিশেষ করে খুজলি-পাঁচড়া, জল বসন্ত আক্রান্ত রোগীর কাপড় প্রতিদিন গোসলের পর সাবান দিয়ে বা সিদ্ধ করে ধুতে হবে। পরিধেয় কাপড় প্রতিদিন পরিস্কার না করা হলে নিজে ও অন্যে এসব রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
দাঁত মাজাঃ
দাঁত মাজা বলতে প্রতিদিন খাবারের পরে দাঁত ব্রাশ বা মেসওয়াক (গাছের ডাল) দিয়ে মাজা বা পরিস্কার করা বুঝায়। দাঁতে অসুখ হওয়ার প্রধান কারণ নিয়মিত দাঁত পরিস্কার না করা, দাঁতে সাধারণত: যে সব রোগ হয় তাহলো দাঁত ক্ষয় হয়ে যাওয়া, মাড়ি ফুলে ব্যথা করা। দাঁতে ক্ষয় রোগ হলে দাঁত অকালে পড়ে যায়, ব্যথা হয়, পুঁজ হয়, মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। প্রত্যেক বার খাবারের পর ভালভাবে কুলকুচা করে মুখ ধুয়ে ফেলা দরকার। তাছাড়া রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এবং সকালে দাঁত মাজার অভ্যাস করতে হবে। দাঁত না মাজলে খাবারের ছোট ছোট কণা দাঁতের ফাঁকে জমে পচন ধরে, ঘা হয়, দাঁত ব্যথা হয়, মুখে দুর্গন্ধ হয়। এর জন্য প্রতিদিন খাবারের পরে ব্রাশ করতে হবে। গরম পানি লবণ দিয়ে কুলকুচা করতে হবে। সম্ভব হলে গরম পানিতে পটাশ দিয়ে মুখ ধুতে হবে। আমাদের গ্রাম বাংলায় নানা ধরনের গাছের ডাল যেমন নিম, বাবলা দিয়ে দাঁতন তৈরী করা যায় যা দাঁতের জন্য উপকারী। ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে নিয়মিত দাঁত মাজার অভ্যাস করতে হবে।
গোসল করাঃ
প্রতিদিন গোসল করা উচিত। গোসল না করলে শরীরে ঘাম ও ময়লা জমে লোমকূপের গোড়া বন্ধ হয়ে যায়। ঘাম বের হতে পারে না। ফলে খুজলী পাঁচড়া চুলকানি রোগ হয়। তাই প্রতিদিন গোসল করা ও সপ্তাহে ১ দিন শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রতঙ্গ নরম কাপড় দিয়ে ঘসে ধুয়ে ফেলতে হবে।
খাওয়ার আগে হাত ধোয়াঃ
খাওয়ার আগে হাত ভালভাবে পরিষ্কার করে ধোয়া। সাবান দিয়ে পরিষ্কার পানি দিয়ে খাবার আগে হাত না ধুলে হাতের ময়লা পেটে গিয়ে আমাশয়, ডায়রিয়া, কৃমি হতে পারে। তাই খাবার আগে হাত ধোয়া একান্ত প্রয়োজন।

স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার ও নিরাপদ পানির ব্যবহার

উন্নত জনস্বাস্থ্যে পূর্বশত হিসাবে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার ও নিরাপদ পানির ব্যবহার প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার বিশেষ উপাদান। বাংলাদেশের শিশুদের মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার ব্যবহার ও নিরাপদ পানির ব্যবহার করতে হবে। বাংলাদেশে সারা বৎসর ডায়রিয়া ও অন্যান্য পেটের অসুখ লেগেই থাকে। এসব রোগের হাত থেকে গ্রামীন জনগণকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই সকলের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার ও সময়মত পায়খানা প্রস্রাবঃ
সরকার গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা স্থাপনের জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের মাধ্যমে অনেক পায়খানা সরবরাহ করেছেন। কিন্তু তা সত্বেও ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব ও অন্যান্য অসুখ কমে নাই। কারণ সঠিক উপায়ে জনগণ নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করতে পারেননি। গ্রামাঞ্চলে মলমূত্র নিষ্কাশন ব্যবস্থা অত্যন্ত নিম্নমানের। পরিবার কল্যাণ সহকারীরা স্থানীয়ভাবে সরকারের অন্যান্য সংশি-ষ্ট বিভাগের সহযোগিতা করে এই কার্যক্রমের তথা তার নিজের কাজের উন্নয়ন করতে পারেন।

যদি শুধুমাত্র ডায়রিয়াকেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তবে অনেক শিশুকে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। ফলে মায়েরা পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণে আগ্রহী হবেন। স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা স্থাপন ও ব্যবহারের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন হলে শ্রমশক্তি বাড়বে এবং সংসারের আয় বাড়বে। প্রতিদিন সময়মত পায়খানা প্রস্রাব করা উচিত। সময়মত পায়খানা না করলে শরীরের অস্বস্তিভাব, পেট ব্যথা, খাওয়ার অরুচি, কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাষ্ট্রিক প্রভৃতি অসুখ বেড়ে যায়। মাথা ঝিম ঝিম করে। প্রসাব সময়মত না করলে কিডনিতে ইনফেকশন হয়।

অনেকক্ষণ যাবৎ প্রস্রাব না করলে প্রস্রাবের থলি থেকে প্রস্রাব বের হয় না। এমন অবস্থা যদি কারো হয় তাহলে পেটে গরম ও ঠান্ডা পানির সেঁক দিতে হবে। বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে কোন কোন এলাকায় দেখা যায় যে পায়খানার সুব্যবস্থা না থাকায় বিশেষ করে মহিলারা দিনের বেলায় পায়খানা না করে, পায়খানা চেপে রাখে এবং রাত্রে পায়খানা করে। এটা স্বাস্থের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব এলাকার লোক জনের উপরে বর্ণিত রোগগুলি বেশী হয়ে থাকে। এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে হলে জনগণকে সময়মত পায়খানা প্রস্রাব করার জন্য পরামর্শ দিতে হবে এবং স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা তৈরী করতে বলতে হবে।

গ্রামবাংলায় স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার অভাবে বেশীর ভাগ সংক্রমণের শিকার হয় মহিলারা। প্রজননতন্ত্রের গঠনের কারণে মহিলার শরীর বা মহিলার মাসিকের সময়, গর্ভ ও মেয়েলী রোগে না ভোগার জন্য পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও পরিস্কার পানির প্রয়োজনীয়তা বেশী অনুভব করে। দৈনন্দিন গৃহকর্ম করার জন্যও পানির অভাবে পরিশ্রম বাড়ে মহিলাদেরই। এ কারণে এসব বিষয়ে মহিলার চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পরিবারের সকলের স্বাস্থ্যের প্রাথমিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করা সম্ভব।
পরিস্কার বা নিরাপদ পানি (নলকুপের পানি অথবা ফুটানো পানি) ব্যবহারঃ
যে পানিতে রোগ জীবাণু নেই এবং ব্যবহারের জন্য নিরাপদ তাকেই আমরা নিরাপদ পানি বলি। নিরাপদ পানি পান না করলে আমাশয়, ডায়রিয়া, কৃমি, টাইফয়েড রোগের সৃষ্টি হয়। এমনকি ডায়রিয়া হয়ে অনেকে মৃত্যু বরণ করেন। এমতাবস্থা হতে রক্ষা পেতে হলে নিরাপদ পানি পান ও ব্যবহার করতে হবে। বিভিন্ন উপায়ে পানিকে নিরাপদ করা যায়। যেমন:
১. পানি ২০ মিনিট ফুটিয়ে ঠান্ডা করে পান করা যায় (ফুটন্ত পানিতে রোগ জীবাণু মারা যায়)।
২. এক কলসী পানিতে এক চিমটি ফিটকারী দিয়ে পানি বিশুদ্ধ করা যায়।
৩. অনেক দোকানে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পাওয়া যায়- যার নাম হেলোজেন। তার দ্বারা পানি বিশুদ্ধ করে খাওয়া যায়।

পারিপার্শ্বিক পরিচ্ছন্নতা

পারিপার্শ্বিক পরিচ্ছন্নতা বলতে বাড়ীর আঙ্গিনা, চারিপাশ পরিষ্কার রাখাকে বুঝায়। বাড়ীর চার পাশের ঝোপ ঝাড় কেটে ফেলা, সম্ভব হলে বাড়ীর দক্ষিণ দিক খোলা রাখা, বাড়ীর আবর্জনা ময়লা একত্র করে তা নির্দিষ্ট একটা গর্তের মধ্যে পুঁতে রাখা। জলাবদ্ধ পায়খানা বাড়ীর উত্তর দিকে থাকা উচিত। পারিপার্শ্বিক পরিচ্ছন্নতা না থাকলে মশা, মাছি, ইঁদুর পোকা মাকড় দেখা দিবে। মশা কামড়ালে ম্যালেরিয়া রোগ হবে এবং মাছি দ্বারা ডায়রিয়া রোগ ছড়াবে। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে সঙ্গে ঘর বাড়ী আঙ্গিনাও পরিস্কার রাখা দরকার। এতে মশা মাছি কম হবে অর্থাৎ অসুখ হবে না। বাড়ীর আশে পাশে জায়গা থাকলে গোয়াল ঘর শোবার ঘর থেকে একটু দূরে রাখা ভাল। গ্রামবাসীকে ব্যক্তিগত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে সঙ্গে পারিপার্শ্বিক পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্যও উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

আমরা যদি প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সচেতন হই তাহলে নিজের শারীরিক পরিচ্ছন্নতা, ঘর-বাড়ির পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে পারবো এবং আমাদের দেশ আরও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা এবং স্বচ্ছ পরিবেশ সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারবো। সর্বোপরি রাসুল (সা.)-এর সুন্নত পালন হবে। আল্লাহর আমাদেরকে তার বিশেষ রহমত ও ভালোবাসা প্রদান করবেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url