কৃষি ক্ষেত্রে জৈব প্রযুক্তির গুরুত্ব ও ব্যবহার
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি খাত থেকে বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের একটি বৃহৎ
অংশ আসে। জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশের ৬৩ শতাংশ মানুষের
কর্মসংস্থান নির্ভর করে কৃষি কাজের উপর। বাংলাদেশের অর্থনীতির হ্রাসবৃদ্ধি এখনো
নির্ভর করে কৃষি উৎপাদনের হ্রাসবৃদ্ধির উপর। বাংলাদেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ
প্রায় ২কোটি ১লাখ ৫৭হাজার একর। প্রতি কৃষকের আবাদি জমির পরিমাণ মাত্র ১.৫০ একর।
সূচিপত্রঃ- কৃষি ক্ষেত্রে জৈব প্রযুক্তির গুরুত্ব ও ব্যবহার
ভুমিকা
জৈব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে ফসলের ফলন বৃদ্ধি, কাঙ্খিত জাত উদ্ভাবন, পোকামাকড় ও
রোগবালাই প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়াও বড় আকারের ফলমূল
উৎপাদন, অল্প সময়ে অধিক চারা একসাথে উৎপাদন প্রজাতির মধ্যে ভিন্নতা আনয়ন,বিলুপ্ত
প্রায় উদ্ভিদের জাত সংরক্ষণ করাও সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে যেকোন মৌসুমে, বছরের
যেকোন সময় যে কোন ধরনের জাত চাষ করা যায় এর জন্য মৌসুমের অপেক্ষা করতে হয়না।
কৃষি উন্নয়নে জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার
মানুষের অন্যতম প্রধান মৌলিক চাহিদা খাদ্য। কিন্তু সীমিত ভূখন্ডে ক্রমবর্ধমান
জনংখ্যা নিয়ে কিভাবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া যায় কিংবা কিভাবে উদ্বৃত্ত খাদ্য
উৎপাদন করে বাবসায়িক ফায়দা, উঠানো যায় তা নিয়ে সারা পৃথিবীতে চলছে এক অঘোষিত
যুদ্ধ। এ যুদ্ধ জয়ের হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে সফল জৈব প্রযুক্তির প্রযোগ।
আরো পড়ুনঃ
ঔষধ শিল্পে জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার
টিস্যু কালচার এবং আণবিক জীববিদ্যাগত কৌশলের প্রাগ্রসর ধারায় নবতর প্রযুক্তি
প্রয়োগের মাধ্যমে বৈচিত্র্য সৃষ্টি এবং তা এক উৎস থেকে অন্য উৎসে স্থানান্তরের
চেষ্টা চালানো হচ্ছে। শস্য উন্নয়নমূলক গবেষণার এসব নতুন দিগন্তকে কৃষি তথা শস্য
উন্নয়নে জৈব প্রযুক্তি বলে অভিহিত করা হয়। কৃষি উন্নয়নে যে সব জৈব প্রযুক্তির
পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় সেগুলোর বর্ণনা দেয়া হলো।
মাইক্রোপ্রোপাগেশন (Micropropatation)
কোষ, কলা ও অজোর কালচার এবং এগুলো থেকে উদ্ভিদের পুনরুৎপত্তি ঘটানোর প্রক্রিয়াকে
মাইক্রোপ্রোপাগেশন বলে। প্রচলিত উদ্ভিদ প্রজনন পদ্ধতি অপেক্ষা মাইক্রোপ্রোপাগেশন
নিম্নোক্ত কারণে বেশী সুবিধাজনক প্রমাণিত হয়েছেঃ
ক) দ্রুত বংশবৃদ্ধি করানো যায়।খ) রোগমুক্ত উৎসের উদ্ভাবন ও সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটানো যায়।
গ) যৌন জননক্ষম সংকর থেকে উদ্ধৃত কিন্তু বন্ধ্যা সদস্যেরও সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটানো যায়।
ইতোমধ্যে অনেক শস্য উদ্ভিদে এ পদ্ধতির সফল প্রয়োগ সম্ভব হয়েছে।
জীবাণু চিহ্নিতকরণ ও নির্মূলকরণ (Dectection and Elimination of
Pathogens):
যে উদ্ভিদ উপাদান অঙ্কুরোগদ্গম বা উদ্ভিদ জননে ব্যবহৃত হবে তাকে রোগমুক্ত করা
অবশ্য কর্তব্য। মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির সাহায্যে জীবাণু সনাক্ত করা হয়। উদ্ভিদের
মেরিস্টেম-চূড়া কালচারের মাধ্যমে ভাইরাস ও অন্যান্য জীবাণু, যেমন-মাইকোপ্লাজম,
ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ নির্মূল করা কার্যকর হয়েছে। ইউরোপ ও উত্তর
আমেরিকায় আলুতে ভাইরাসের সংক্রমণ বিনাশে এ প্রযুক্তির প্রয়োগ করা হয়।
সোমাক্লোনাল ও গ্যামেটোক্লোনাল বৈচিত্র্য (Somaclonal and Gametoclonal
Variation):
টিস্যু কালচারের সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কিছু পরিবর্তন ঘটে যায়। এ পরিবর্তন শস্য
উন্নয়নে বৈচিত্র্যের এক বিরাট উৎস হিসেবে কাজ করে। কখনও বা এসব পরিবর্তনের হার
প্রত্যাশিত মিউটেশনের চেয়েও বেশী হয়ে যায়। দৈহিক কোষ বা কলার কালচারে যে সব
পরিবর্তনের উদ্ভব ঘটে তাকে সোমাক্লোনাল বৈচিত্রা বলে। দুই ধরনের পরিবর্তনই শস্য
উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা পালন করে।
উদ্ভূত গুণাগুণকে কোষীয় লেভেলেই বাছাই করে পরবর্তী উদ্ভিদ প্রজন্মে ভাল গুণাবলীর
(যেমন-নির্দিষ্ট বালাইনাশক, ছত্রাক বিষ ও বিদূষক প্রতিরোধ এবং চরম উষ্ণতা ও বেশী
লবণাক্ততা সহনযোগ্য) সন্নিবেশ ঘটানোর ব্যবস্থা করা হয় এবং এসব বৈশিষ্ট্য
প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত হতে থাকে।
কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্যের পৃথকীকরণ
জৈবপ্রযুক্তি প্রয়োগ করে এমনভাবে কোষ-কালচার করা হয় যার ফলে লক্ষ লক্ষ কোষের
বাছাইকরণ সম্ভব হচ্ছে। সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞানীরা কাঙ্খিত অনেক
বৈশিষ্ট্য পৃথক করেছেন। সফল ও কার্যকরভাবে এর ফলে রোগ প্রতিরোধ (তামাক ও
ভুট্টা-য়), বালাইনাশক প্রতি রোধ (টমেটো, আলু, তামাক ও সয়াবিণ), লবণাক্ততা ও শৈত্য
সহন (ধুতুরা, তামাক ও ধানে) গুণাবলী সম্পন্ন উদ্ভিদ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে।
সংকরায়ণ
প্রোটোপ্লাস্ট একীভবন কৌশলের মাধ্যমে সংকরায়ণ ঘটিয়ে শস্য উন্নয়ন কার্যক্রমের
প্রসার ঘটানো জৈব প্রযুক্তির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। প্রোটোপ্লাস্ট একীভবন
প্রযুক্তি প্রয়োগের প্রধান উদ্দেশ্য তিনটি।
ক) জীনগত ভিন্ন প্রজাতির সংকর সৃস্টি।
খ) জীনগত ভিন্ন প্রজাতির মধ্যে একটি বা কয়েকটি ক্রোমোসোম বা জীনের স্থানান্তর।
গ) এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে কোষীয় অঙ্গাণু, যেমন-নিউক্লিয়াস,
মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্ট স্থানান্তর।
উল্লেখিত প্রযুক্তির সুবাদে শক্তিশালী, ব্যাপক অভিযোজনক্ষম, রোগ প্রতিরোধী,
বালাইনাশক প্রতিরোধী, নাইট্রোজেন স্থিতিকরণে সক্ষম, অধিক ফলনশীল প্রভৃতি গুণাবলী
সম্পন্ন শস্য উদ্ভিদ উদ্ভাবন সম্ভব হচ্ছে।
দূর সংকরায়ণ ও ভ্রূণ উদ্ধার (Wide Hybridization and Embryo Rescue):
কাঙ্খিত বৈচিত্র্যের মাত্রা বাড়ানোর আরেক কৌশল হচ্ছে আন্তঃপ্রজাতিক
(Interspectific) ও আন্তঃগণিক (Intergeneric) সংকরায়ণ। এর ফলে চাষযোগ্য শস্যে রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা, ফলনশীলতা ও অভিযোজন ক্ষমতা বেড়েছে।
পুংকেশর ও পরাগ কালচার (Anther and microspore culture)
অধুনা দূর সংকরায়ণ ও ভ্রূণ উদ্ধার এবং পুংকেশর কালচারের মাধ্যমে হ্যাপ্লয়েড
উদ্ভিদ সৃষ্টি হচ্ছে। এসব পদ্ধতির মধ্যে পুংকেশর কালচারের পদ্ধতিই বেশী ব্যবহৃত
হয়। হ্যাপ্লয়েড উদ্ভিদ উদ্ভাবনের জন্য ১৯৬৭ সাল থেকে গম, বার্লি, ভুট্টা, ধান,
রাই, তুলা, আলু, তামাক প্রভৃতি শস্য ব্যাপক ব্যবহৃত হচ্ছে।
জীন প্রকৌশল (Genetic Engineering)
জীন প্রকৌশলের মাধ্যমে জীনের স্থানান্তর ঘটিয়ে যে সব উদ্ভিদ সৃষ্টি করা হয় তাদের
ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ (transgenic plants) বলে। এ প্রক্রিয়ায় রিকম্মিনেন্ট DNA
কৌশল প্রযোগ করে উৎপন্ন জীবকে হয় কোনো বাহকের মাধ্যমে নয়তো মাইক্রোইঞ্জেকশনের
মাধ্যমে উদ্ভিদের প্রোটোপ্লাস্টে প্রবেশ করানো হয়। বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায়
৬০টি উচ্চতর উদ্ভিদ প্রজাতিতে এ প্রক্রিয়ার সফল প্রয়োগ করা হয়েছে। উচ্চতর উদ্ভিদ
প্রজাতিগুলোর মধ্যে রয়েছে তামাক, টমেটো, আলু, মিষ্টি আলু, লেটুস, সূর্যমুখী,
বাঁধাকপি, তুলা, সয়াবিন, মটর, শসা, গাজর, মূলা, পেঁপে, আঙ্গুর কৃষ্ণচূড়া, গোলাপ,
আপেল, নাশপাতি, নিম, ধান, গম, রাই, ভুট্টা ইত্যাদি।
উপসংহার
ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থকরী ফসলকে আগাছানাশক, পতা,
ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক প্রতিরোধী করে উৎপাদন করা হচ্ছে। অনেক উদ্ভিদকে
উষ্ণতা, শৈত্য, লবণাক্ততা, ভারী ধাতু, ফাইটোহরমোন, নাইট্রোজেন প্রভৃতি মোকাবিলায়
সক্ষম করে তোলা হয়েছে। পাকা টমেটোর ত্বক নরম হয়ে যাওয়া প্রতিরোধে কিংবা দেরীতে
পাকানো অথবা সুক্রোজের পরিমাণ বাড়িয়ে স্টার্চের পরিমাণ কমিয়ে টমেটো উৎপাদন
ট্রান্সজেনিক প্রক্রিয়ারই সুফল। আলুতে ২০-৪০% স্টার্চ বাড়ানোও সম্ভব হয়েছে এ
প্রক্রিয়ায়।
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url