ঔষধ শিল্পে জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার

পৃথিবীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষই সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। অথচ প্রতি বছর জনসংখ্যা ও রোগের জটিলতা বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসা সুবিধা পৌঁছে দিতে বিজ্ঞানীরা জীবপ্রযুক্তির আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে দ্রুত ঔষধ (drugs) শিল্পের উন্নতি ঘটছে। মারাত্মক রোগ ব্যাধি সনাক্তকরণের পাশাপাশি জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে ওষুধ উৎপাদনের প্রক্রিয়া জোরালো হয়েছে। নিচে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো।
(১) ভ্যাকসিন উৎপাদনঃ রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবের বিরুদ্ধে আগে থেকেই কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেহকে অনাক্রম্য করার উদ্দেশ্যে ভ্যাকসিন অপরিহার্য। জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে নিম্নোক্ত ৩ উপায়ে ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হয়।
মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ব্যবহার করে অনাক্রম্যবিশুদ্ধকরণঃ
এ প্রক্রিয়ায় প্রায় একই রকম অ্যান্টিজেনের মিশ্রণ থেকে একটি নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেন আলাদা করে নেয়া হয়। বিশুদ্ধ এ অ্যান্টিজেনকে জীবাণুর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন উৎপন্ন করার কাজে লাগানো হয়। একটি অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া থাকায় মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ব্যবহার করলে বিশুদ্ধিকরণ সবচেয়ে ভালো হয়। বিশুদ্ধিকরণের পর এসব ভ্যাকসিন বাজারজাত করা হয়। [ইম্যুনোগ্লোবিউলিন ক্ষরণকারী কোষকে প্লাজমা কোষ (plasma cell) বলে। কেবল এক ধরনের প্লাজমাকোষের ক্লোন থেকে উৎপন্ন ইয়্যুনোগ্লোবিউলিনকে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি বলে।]
ক্লোন্ড জীনের সাহায্যে অ্যান্টিজেন সংশ্লেষঃ
ইউক্যোরিওটিক কোষে জিনোমিক DNA বা কমপ্লিমেন্টারি DNA (CDNA) থেকে শত শত জীন ক্লোন করা যায়। এসব ক্লোন্‌ড জীনে নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনের জন্য কিছু জীন থাকে। ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য এসব জীনকে অ্যান্টিজেন সংশ্লেষের কাজে লাগানো হয়। এভাবে উৎপন্ন ভ্যাকসিনের মধ্যে হেপাটাইটিস ও ভ্যাকসিন অন্যতম। আশা করা হচ্ছে, খুব শীঘ্রই ম্যালেরিয়া রোগবিরোধী ভ্যাক্সিনও এভাবে উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
ভ্যাকসিন রূপে ব্যবহার্য পেপটাইড সংশ্লেষঃ
সংশ্লেষিত ক্ষুদ্র পেপটাইড শৃঙ্খল তৈরির মাধ্যমে ভ্যাকসিন উৎপাদন জৈব প্রযুক্তির এক উল্লেখযোগ্য গবেষণা-সাফল্য। যে পেপটাইড শৃংখলকে ভ্যাকসিন হিসেবে ব্যবহার করা হবে প্রথমে তার প্রোটিনগত গঠন ও কাজ জেনে নিতে হয়।
এর কোন্ অংশটি অনাক্রম্যতার প্রতি সাড়া দেয় তা বের করতে হয়। এরপর কৃত্রিম উপায়ে সেই নির্দিষ্ট প্রোটিন সংশ্লেষ করে ভ্যাকসিন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় গবাদি পশুর ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ ভাইরাস (FMDV) এর বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু হয়েছে।
(২) ইন্টারফেরণ উৎপাদনঃ ইন্টারফেরণ হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রোটিনের একটি গ্রুপ যাদের আণবিক ওজন ২০ হাজার-৩০ হাজার ড্যালটন। ভৌত-রাসায়নিক ও অ্যান্টিজেনজনিত গুণের ভিত্তিতে ইন্টারফেরণ ৩ রকমঃ Interferon-α, Interferon-ẞ. Interferon-γ। ইন্টারফেরণ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ভাইরাসজনিত Interference অর্থাৎ ব্যাঘাত থেকে। শরীরে ভাইরাস অনুপ্রবেশের পর এদের প্রচন্ড কর্মক্ষমতার জন্য ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি রহিত হয়।
শুধু তাই নয়, ইন্টারফেরণ-
(ক) অনাক্রম্যতন্ত্র (Immune System)-কে নিয়ন্ত্রণ করে।
(খ) B ও T লিম্ফোসাইটের সংখ্যাবৃদ্ধিকে দমন করে।
(গ) অ্যান্টিবডি উৎপাদনে বাধা দেয়।
(৪) ND কোষ (Natural Killer cells)-এর ক্ষমতা ও বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে ক্যান্স্যার কোষের সংখ্যাবৃদ্ধিতে বাধা দেয়।
(৫) পোষকের অনাক্রম্যতা বাড়িয়ে ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করে।
বর্তমানে ক্লোনূন্ড জীনকে প্লাজমিড বাহকের মাধ্যমে Saccharomyces cerevisiae-র কোষে ঢুকিয়ে ইন্টারফেরণ উৎপাদিত হচ্ছে।
(৩) হরমোন উৎপাদনঃ রিকম্বিনেন্ট DNA ও জীন ক্লোনিং পদ্ধতির প্রাগ্রসরতার সাথে সাথে মানুষের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন হরমোনের বাণিজ্যিক উৎপাদন মানুষের মনে নতুন আশার আলোর সঞ্চার করেছে। এ প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট হরমোনের সংকেত বহনকারী নির্দিষ্ট জীনকে পৃথক করে প্লাজমিডের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার ভেতরে উৎপন্ন করা হয়। ফলে উৎপাদন বেশী ও সহজসাধ্য হয় এবং দামও কম পড়ে।ব্যাকটেরিয়ার ভেতর প্লাজমিডের মাধ্যমে রিকম্বিনেন্ট DNA প্রবেশ করিয়ে উৎপাদিত হচ্ছে ইনসুলিন, সোমাটোট্রপিন (বৃদ্ধি হরমোন), সোমাটোস্ট্যাটিন (ইনসুলিন ও বৃদ্ধি হরমোন দমনকারী হরমোন), সোমাটোমিডিয়া A (তরুণাস্থিতে সালফার স্থায়ীকরণ), সোমাটোমিডিয়া B (চক্রিয় কোষে DNA সংশ্লেষণ), থুওট্রপিন (থাইরয়েড গ্রন্থি নিয়ন্ত্রণকারী), থাইমোপোয়েটিন (থাইমিক হরমোন) প্রভৃতি।
(৪) অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদনঃ দেহে প্রবেশিত রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবের (ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া) বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এবং কম সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদনের জন্য জৈব প্রযুক্তি বিশেষভাবে এগিয়ে এসেছে।
বর্তমানে এক হাজারেরও বেশী অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদিত হচ্ছে তন্তুময় ছত্রাকের ৬টি গণভুক্ত সদস্য থেকে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে Penicillium Cephalosporium গণ। এদের থেকে যথাক্রমে পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন অ্যান্টিবায়োটিক উৎপন্ন হয়।
(৫) এনজাইম উৎপাদনঃ পরিপাক সংক্রান্ত রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের উপাদান হিসেবে কিছু এনজাইম, যেমন-অ্যামাইলেজ, প্রোটিয়েজ ও লাইপেজ); পেঁপে থেকে প্যাপেইন ও বট থেকে ফাইসিন (কৃমিরোগে); গবাদি পশুর প্লাজমা থেকে এম্মিন (রক্তপাত বন্ধে); এবং ক্ষত নিরাময়ে ট্রিপসিন ব্যবহৃত হয়। জৈব প্রযুক্তির কল্যাণে এসব এনজাইম উৎপাদিত ও বাজারজাত হচ্ছে।
(৬) ট্রান্সজেনিক প্রাণী থেকে ওষুধ আহরণঃ ট্রান্সজেনিক প্রাণী উদ্ভাবনের মাধ্যমে প্রাণিগুলোকে বায়োরিএক্টর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এসব প্রাণীর দুধ, রক্ত ও মূত্র থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ আহরণ করা হয়। একে মলিকুলার ফার্মিং বলে।
বিভিন্ন ট্রান্সজেনিক প্রাণী (শূকর, গরু, ছাগল ও ভেড়া) থেকে মানুষের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় আরও যে সব প্রোটিন আহরণ করা হয় সেগুলো হচ্ছেঃ
প্রোটিনের নাম প্রয়োগ ক্ষেত্র
১। এন্টিগ্রন্থিন III ১। রক্তনালীর ভেতর রক্ত জমাট।
২। কলাজেন ২। পোড়া ও হাড় ভাঙ্গা।
৩। ফিব্রিনোজেন ৩। পোড়া ও শল্যচিকিৎসা।
৪। ফার্টিলিটি হরমোন ৪। গর্ভধারণ।
৫। হিমোগ্লোবিন ৫। রক্তাল্পতা।
৬। সিয়াম অ্যালবুমিন ৬। শল্যচিকিৎসা, ক্ষত ও পোড়া।
৭। মনোক্লোনাল এন্টিবডি ৭। মলাশয় ক্যান্সার।
৮। আলফা ১ এন্টিট্রিপসিন ৮। করোনারি ব্রহ্মোসিস।
১০। ইন্টারলিউকিন-২ ১০। কয়েক ধরনের ক্যান্সার।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url