জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কি-জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কোনটা ভালো

জন্ম নিয়ন্ত্রণ বা গর্ভবিরতিকরণ বা গর্ভনিরোধ বা প্রজনন নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে গর্ভধারণ প্রতিরোধের এক বা একাধিক কর্মপ্রক্রিয়া, পদ্ধতি, সংযমিত যৌনচর্চা অথবা ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে ঐচ্ছিকভাবে গর্ভধারণ বা সন্তান প্রসব থেকে বিরত থাকার স্বাস্থ্যবিধি। জন্ম নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা, বিধান ও ব্যবহারকে পরিবার পরিকল্পনা বলা হয়। যৌন সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য ও নিরাপদ যৌনতা রক্ষার জন্য কনডম ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রাচীনকাল থেকেই জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু এর কার্যকর ও নিরাপদ পদ্ধতি শুধুমাত্র বিশ শতকের মধ্যেই সহজলভ্য হয়ে ওঠে। কিছু সংস্কৃতিতে ইচ্ছাকৃতভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। কারণ সেসব সংস্কৃতিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করারকে রাজনৈতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির পরিপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

সূচিপত্রঃ- জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কি-জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কোনটা ভালো

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সমুহ

যে সমস্ত উপকরণ বা যার মাধ্যমে গর্ভসঞ্চারে বাধা প্রদান করা হয়, সেই সমস্ত উপকরণ বা মাধ্যমকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বলে। মহিলা ও পুরুষের ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন প্রকার জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি রয়েছে। এই পদ্ধতিগুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
(ক) সনাতন পদ্ধতি
(খ) আধুনিক পদ্ধতি

জন্মনিয়ন্ত্রণের সনাতন পদ্ধতি (Traditional Methods)

মহিলাদের স্বাভাবিক প্রজনন চক্র ও তার পরিবর্তনসমূহ বুঝতে পারা এবং তার উপযুক্ত ব্যবহারই হচেছ সনাতন পদ্ধতি। সনাতন পদ্ধতিতে গর্ভনিরোধ কোন রাসায়নিক বা কৃত্রিম পদ্ধতির সাথে জড়িত নয়। যেমন- একজন মহিলা যদি ডিম্বক্ষরণের সঠিক সময় জানতে পারেন, তা'হলে ঐ সময় সহবাস না করে তিনি গর্ভনিরোধ করতে পারেন। এটাকেই সনাতন পদ্ধতি বলে।
অথবা একজন পুরুষ যদি মহিলার যোনীপথ থেকে বীর্য নির্গত হওয়ার পূর্বেই লিংজ্ঞ বের করে আনতে পারেন, এটাও একটা সনাতন পদ্ধতি। সনাতন পদ্ধতি ব্যবহারে দম্পতিকে খুব দায়িত্ববান এবং সংযমী হতে হয়। যে সকল দম্পতি সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার বেছে নেন তাদেরকে অবশ্যই এই পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক ভাবে জানতে হবে। এই পদ্ধতিগুলো পরিবারের সদস্য সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ঐতিহ্যগতভাবে সমাজে প্রচলিত আছে।
সংজ্ঞাঃ
যে সমস্ত পদ্ধতি প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত হয়ে আসছে এবং যে পদ্ধতির জন্য কোন উপকরণের প্রয়োজন হয় না, তাকে সনাতন পদ্ধতি বলে।
এগুলো হচ্ছে-
১. প্রত্যাহার বা আযল।
২. বাচ্চাকে শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো।
৩. ছান্দিক পদ্ধতি বা নিরাপদকাল (Rhythm method মেনে চলা বা Safe Period)
  • শেষ্মা পদ্ধতি (Mucus method)
  • দিন গণনা/পঞ্জিকা পদ্ধতি (Calendar method)
  • তাপমাত্রা পরিবর্তন পদ্ধতি (Temperature method)
৪. সহবাস থেকে বিরত থাকা বা আত্মসংযম।
৫. দেরীতে বিয়ে।
কার্যকারিতাঃ
এই পদ্ধতিতে কার্যকারিতা (জন্মনিয়ন্ত্রণের কাজে) অনেক কম অর্থাৎ গর্ভসঞ্চারের সম্ভাবনা অনেক বেশী তথাপি কোন পদ্ধতি ব্যবহার না করার চেয়ে অনেক ভাল)।

জন্মনিয়ন্ত্রণের আধুনিক পদ্ধতি (Modern methods)

যে সমস্ত পদ্ধতি বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর আবিস্কৃত হয়েছে তাকে আধুনিক পদ্ধতি বলে।
এই পদ্ধতিকে আবার দুইভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- কনডম, খাবার বড়ি, ফোম, আইইউডি, নরপ-ান্ট, বন্ধ্যাকরণ (এর জন্য পৃথক উপকরণ প্রয়োজন হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তির প্রয়োজন হয়)
কার্যকারিতাঃ
এই পদ্ধতিতে গর্ভসঞ্চারের সম্ভাবনা কম বললেই চলে। তবে পুরুষের জন্য কনডমের ব্যবহারের ব্যর্থতার হার কিছু বেশী।

(১) নন- ক্লিনিক্যাল পদ্ধতিঃ

যে পদ্ধতিগুলো অন্যের সাহায্য ছাড়া ক্লায়েন্ট নিজেই ব্যবহার করতে পারেন সেগুলিকে নন- ক্লিনিক্যাল পদ্ধতি বলে।
(ক) খাবার বড়ি (এটা মূলত: ক্লিনিক্যাল পদ্ধতি হলেও আমাদের দেশে এ যাবৎ নন-ক্লিনিক্যাল পদ্ধতি হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয়ে আসছে)
(খ) কনডম

(২) ক্লিনিক্যাল পদ্ধতিঃ

(ক) অস্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিঃ

যে সকল পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য ক্লায়েন্টকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সেবাদানকারীর সাহায্য নিতে হয় সেই সকল পদ্ধতিকে ক্লিনিক্যাল পদ্ধতি বলে।
  • ইনজেকশন (Injection or Injectable contraceptive)
  • আইইউডি (IUD) যেমন: কপার-টি,
  • নরপ্লান্ট (Norplant)

(খ) স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিঃ

  • পুরুষ বন্ধ্যাকরণ
  • মহিলা বন্ধ্যাকরণ

ক্যাফেটেরিয়া প্রক্রিয়া

ক্যাফেটেরিয়া প্রক্রিয়া বলতে বুঝায় বিভিন্ন প্রকার জিনিসের মধ্য থেকে যে কোন একটি জিনিস পছন্দ করা। যেমনঃ খাবারের দোকানে নানা ধরনের খাবার জিনিস থেকে পছন্দনীয় / প্রয়োজনীয় জিনিস বেছে নেয়ার সুযোগ থাকে।
ক্রেতা তার চাহিদা ও পছন্দ অনুযায়ী খাবার বেছে নেন, তেমনি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহীতারা পরিবার পরিকল্পনা সেবাদান কেন্দ্রে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি থাকার কারণে তাদের চাহিদা ও পছন্দ অনুযায়ী পদ্ধতি বেছে নিতে ও স্বাস্থ কর্মীর পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারবেন। কোন পদ্ধতি জোর করে কারো উপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না।
পুরুষ মহিলা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
ধরণ পুরুষ পদ্ধতি মহিলা পদ্ধতি
সংজ্ঞা জন্মনিয়ন্ত্রণের এর যে সমস্ত পদ্ধতি পুরুষদের জন্যে প্রযোজ্য সেগুলিকে পুরুষ পদ্ধতি বলে। জন্মনিয়ন্ত্রণ এর যে সমস্ত পদ্ধতি মহিলাদের জন্য প্রযোজ্য সেগুলিকে মহিলা পদ্ধতি বলে।
ধরণ কনডম, ভ্যাসেকটমি, আযল বড়ি, ইনজেকশন, আইইউডি, নর-প্লান্ট
পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া পুরুষদের জন্যে পদ্ধতি সমূহ ব্যবহারে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ঝুঁকি অত্যন্ত কম। কনডম ব্যবহার করা সহজ। শরীরের কোন ক্ষতি করে না। পুরুষ বন্ধ্যাকরণে জটিলতা কম এবং অপারেশনের পর পরই বাসায় আসা যায় এবং এক সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিক কাজ কর্মে ফিরে যাওয়া যায়। মহিলাদের জন্য পদ্ধতি সমূহ ব্যবহারে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ও জটিলতা অপেক্ষাকৃত বেশী।

জরুরী গর্ভনিরোধক (Emergency Contraceptives)

জরুরী গর্ভনিরোধক হলো এক প্রকার পদ্ধতি যা অরক্ষরিত সহবাসের পরে ব্যবহার করে অনাকাংক্ষিত গর্ভ প্রতিরোধ করা যায়। ধর্ষণ (Rape) এর ব্যবস্থাপনায় জরুরী গর্ভনিরোধক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে ভুলে গেলে বা কোন কারনে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার না করে সহবাস করলে, পরে এটি ব্যবহার করে গর্ভনিরোধ করা যায়। জরুরী গর্ভনিরোধক এর ৩টি পদ্ধতি আছে যথা-
(১) মিশ্র জরুরী গর্ভনিরোধক বড়ি যেমনঃ এস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন মিশ্রিত হরমোন বড়ি।
(২) শুধুমাত্র প্রজেস্টেরন যুক্ত জরুরী গর্ভনিরোধক বড়ি।
(৩) আইইউডি। যেমন- কপার-টি (Copper-T)।

১. জরুরী গর্ভনিরোধক মিশ্রবড়িঃ

(ক) উচ্চ মাত্রার বড়িঃ
এর প্রতি ট্যাবলেটে ০.৫ মিলিগ্রাম এসট্রোজেন এবং ৫০ মাইক্রোগ্রাম প্রজেস্টেরন থাকে।
ব্যবহারবিধিঃ
অনিয়ন্ত্রিত বা অরক্ষিত যৌন মিলনের ৭২ ঘন্টা বা ৩ দিনের মধ্যে ১ম ডোজ ২টি বড়ি (যত তাড়াতাড়ি খাবে ততই ভালো) এবং ১ম ডোজের ১২ ঘন্টা পর আরও ২টি বড়ি বা ২য় ডোজ খেতে হবে।
(খ) স্বল্প মাত্রার বড়িঃ
সুখী, ফেমিকন, নরটেড-২৮ এসব বড়িতে ০.৩ মিঃগ্রাঃ ইস্ট্রোজেন থাকে (অর্থাৎ স্বল্প মাত্রার মিশ্রবড়ি)
ব্যবহারবিধিঃ
চিকিৎকের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে হবে।

২. জরুরী গর্ভনিরোধ শুধুমাত্র প্রজেস্টেরন যুক্ত বড়ি

এতে শুধুমাত্র ০.৭৫ মিলিগ্রাম প্রজেস্টেরন থাকে।
ব্যবহারবিধিঃ
চিকিৎকের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে হবে।

৩. জরুরী গর্ভনিরোধক হিসাবে আইইউডি (কপার - টি)

অরক্ষিত যৌন মিলনের ৫ দিনের মধ্যে কপার-টি পড়ানো হলে গর্ভনিরোধক কার্যকরী হবে। শুধু মাত্র যাদের একটি বাচ্চা হয়েছে বা গর্ভপাত হয়েছে এবং যারা এখনই বাচ্চা চান না তারা শুধু এটা ব্যবহার করতে পারেন। জরুরী গর্ভনিরোধক বড়ি ব্যবহারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
বার বার এর ব্যবহার করা সমীচিন নয়। এর ব্যবহারে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে তবে এর ব্যবহারে প্রয়োজনে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করে মতামত গ্রহণ করতে হবে। ব্যবহারে ব্যর্থ হলে (অর্থাৎ নিদিষ্ট সময়ে মাসিক না হলে) অবশ্যই চিকিৎসকের মতামত গ্রহণ করতে হবে।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কোনটা ভালো?

জন্ম নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি গুলোর মধ্যে, পুরুষদের ক্ষেত্রে ভেসেকটমি (৯৯.৮৫% সাফল্যের হার) আর মহিলাদের ক্ষেত্রে টিউবাল বন্ধ্যাকরণ (tubal ligation) (৯৯.৫% সাফল্যের হার) অথবা টিউবেকটমি। এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় মৌখিক ঔষধ, প্যাচ, যোনি আংটি, এবং ইনজেকশনসহ হরমোন ঘটিত গর্ভনিরোধক অনুসারে।
তথ্যসুত্রঃ (পরিবার কল্যাণ সহকারী এবং পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক) সহায়ীকা

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url