প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা-প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার উপাদান

স্বাস্থ্য কেবলমাত্র শারীরিক রোগমুক্ত নয়- শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আর্থিক সুস্থতাই স্বাস্থ্য। মানুষ সবচেয়ে ভাল থাকে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে যেখানে তারা একে অন্যকে বিশ্বাস করে, দৈনিক প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করে এবং একে অন্যকে সম্পূর্ণরূপে বাঁচতে সাহায্য করে।

সূচিপত্রঃ- প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা-প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার উপাদান

১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, সোভিয়েত রাশিয়ার কাজাক প্রদেশের রাজধানী আলমা আতা শহরে একটি বিরাট স্বাস্থ্য সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এই সমাবেশে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অংশ গ্রহণ করে। সমাবেশে স্বাস্থ্যকে মানুষের মৌলিক চাহিদা হিসাবে চিহ্নিত করে বিশ্বব্যাপী সম্ভবপর সর্বোত্তম স্বাস্থ্য মান অর্জনের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ২০০০ সালের মধ্যে প্রতিটি মানুষের মান উন্নয়ন করা হবে, যেন সে সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে ফলপ্রসু জীবন যাপন করতে পারে।

প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা কি

প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা হচেছ- ব্যাক্তি ও নাগালের মধ্যে গ্রহণযোগ্য একটি অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্য পরিচর্যা যা জনগোষ্ঠির সম্পূর্ণ সহযোগিতায় বাস্তবায়িত হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা জাতীয় স্বাস্থ্য ও আর্থ- সামাজিক অবস্থা ও উন্নতির একটি অবিচেছদ্য অঙ্গ। আমাদের দেশে এমন অনেক রোগ আছে যার কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার নানা বয়সের লোক বিশেষ করে শিশুরা মৃত্যুবরণ করেছে। এই সকল রোগের মধ্যে ডায়রিয়া, ধনুষ্টংকার যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হাম, হুপিং কাশি, পোলিও, শ্বাস-তন্ত্রের সংক্রমণ, অপুষ্টি, কৃমি ও প্রসূতি মৃত্যু প্রভৃতি অন্যতম। এসকল রোগ জনগনের সচেতনতা, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও সামাজিক ব্যবস্থার সাহায্যে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বর্তমানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা আওতায় এই সকল রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাপক কর্মসূচী নেয়া হয়েছে।

প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা কি কি

শারীরিক সুস্থতাঃ
শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গসমূহের স্বাভাবিক কাজ করতে পারাকে শারীরিক সুস্থতা বলে। এর জন্য দরকার সুষম খাদ্য, নিরাপদ পানি, পরিস্কার পরিচছন্ন বাসগৃহ, নিয়মিত পরিমিত ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রম।
মানসিক সুস্থতাঃ
শুধুমাত্র মানসিক ব্যধি না থাকলেই মানসিক সুস্থতা বলা যাবে না। একজন মানসিক দিক থেকে সুস্থ ব্যক্তি নিজের মধ্যে কোন অন্তর্দ্বন্ধে ভোগে না। অপরদিকে সে তার পরিবার পরিজনসহ সমাজের সকলের সাথে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্প্রতি ও সহযোগিতার পরিবেশে বাস করতে আনন্দবোধ করে। নিজের বুদ্ধি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাবলে দৈহিক জীবনে সকল সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট হয়। মানসিক সুস্থতা আবার শারীরিক ও সামাজিক সুস্থতার উপর নির্ভরশীল।
সামাজিক সুস্থতাঃ
মানুষ সামাজিক জীব। দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে সুস্থ ও সবল ব্যক্তি এককভাবে স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে পারে না। সুন্দর ও সুস্থভাবে বাঁচার জন্য অপরের সাহায্য সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। সে প্রাথমিকভাবে একজন পরিবারের সদস্য এবং পরবর্তীতে সমাজের তথা বৃহত্তর জনগোষ্ঠির একজন সদস্য। বস্তুতঃ সামাজিক আচার, আচরণ, কৃষ্টি, সভ্যতা, কুসংস্কার, পেশা ও অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা ইত্যাদি মানুষের শারীরিক ও সামাজিক সুস্থতার উপর প্রভাব ফেলে।
আত্মিক সুস্থতাঃ
আত্মা সত্য, সুন্দর ও অবিনশ্বর। মানুষের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক অবস্থা ভাল থাকলে আত্মা পরিতৃপ্ত থাকে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি অবিচল বিশ্বাস রাখাই হলো আন্তরিক সুস্থতা। মানসিক সুস্থতা ও আত্মিক সুস্থতা পারস্পরিক নির্ভরশীল।

প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার উপাদান

বাংলাদেশের পটভূমিতে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার ৯টি উপাদান রয়েছে। যথা-
১. বিরাজমান স্বাস্থ্য সমস্যা এবং এদের প্রতিরোধ ও দমন সম্বন্ধে স্বাস্থ্য শিক্ষা।
২. মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং পরিবার পরিকল্পনা।
৩. প্রতিষেধক টিকার মাধ্যমে সংক্রামক ব্যধির হাত থেকে রক্ষা করা।
8. খাদ্য সরবরাহ উন্নয়ন এবং যথার্থ পুষ্টিমান অর্জন।
৫. নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতকরণ।
৬. স্থানীয় রোগ প্রতিরোধ ও দমন।
৭. সাধারণ রোগ ও ক্ষতের যথার্থ চিকিৎসা।
৮. প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহ নিশ্চিতকরণ।
৯. মানসিক সুস্থতা।

প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার ক্ষেত্র

স্বাস্থ্য পরিচর্যার ৩টি ক্ষেত্র হচ্ছে উন্নয়নমূলক, প্রতিরোধমূলক এবং আরোগ্যমূলক সেবা। একজন মাঠকর্মী জনগোষ্ঠীর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কর্মী তাদের স্বাস্থ্য সমস্যা ও প্রয়োজন সম্বন্ধে সচেতন। তাই কর্মীই বুঝবেন তাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার প্রয়োজনগুলো কি এবং প্রয়োজন মেটানোর যথার্থ উপায় কি? সেবা প্রদানের মাধ্যমে মাঠকর্মী জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যের মান উন্নয়ন, সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধ এবং কিছু সাধারণ অসুস্থতার হাত থেকে আরোগ্য লাভ করার ব্যবস্থা করবেন।
উন্নয়নমূলক সেবাঃ
উন্নয়নমূলক সেবা প্রদানের মুলে জনগোষ্ঠীর জীবন ধারায় সুস্বাস্থ্যের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। যেমনঃ
  • স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ে জনগোষ্ঠীর সচেতনতা বাড়ানো।
  • স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হলে যেন তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে এই লক্ষ্যে তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ে জ্ঞানদান।
  • সুষম পুষ্টিকর খাবার গ্রহণে উৎসাহ প্রদান।
  • স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান, পায়খানা ও নিরাপদ পানি নিশ্চিতকরণ।
প্রতিরোধমূলক সেবাঃ
রোগ প্রতিরোধক সেবা প্রদানের মাধ্যমে রোগের উৎপত্তি রোধ করে বিস্তার কমানো সম্ভব। যেমন-
  • বাচ্চাদের রোগ প্রতিষেধক টিকা দিয়ে সাতটি মারাত্মক রোগের হাত থেকে বাঁচানো।
  • গর্ভকালীন সময়ে টিকা দিয়ে মা ও নবজাতক শিশু উভয়কে ধনুষ্টংকার থেকে রক্ষা করা।
  • বাচ্চাদের ৬ মাস পর পর ভিটামিন 'এ' ক্যাপসুল খাইয়ে রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করা।
আরোগ্যমূলক সেবাঃ
আরোগ্যমূলক সেবার মাধ্যমে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সময়মত সঠিক চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। যেমন-
  • ডায়রিয়া রোগীদের স্যালাইন খাওয়ানো।
  • রাতকানা রোগে আক্রান্ত বাচ্চাদের ভিটামিন 'এ'ক্যাপসুল সরবরাহ।
  • জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের সেবা ও পরামর্শ।
  • যন্ত্রা বা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পাঠানো।
উন্নয়নমূলক, প্রতিরোধমূলক ও আরোগ্যমূলক এই তিন ধরনের সেবার মধ্যে সমতা রাখার মাধ্যমেই কাজে সফলতা আসবে। এককভাবে কোন সেবা প্রদানে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। যেমন- কাজের লক্ষ্য। যদি অপুষ্টিজনিত অন্ধত্ব রোধ করা হয় তা হলে এই লক্ষ্যে যা করা হবে তা হলো- উন্নয়নমূলক সেবা হিসাবে এলাকাবাসীদের অপুষ্টিজনিত অন্ধত্বের কারণ ও রোধের উপায় সম্পর্কে স্বাস্থ্য শিক্ষা দেয়া। প্রতিরোধমূলক সেবা হিসাবে বাচ্চাদের ৬ মাস পর পর একটি করে ভিটামিন 'এ' ক্যাপসুল খাওয়ানো। আরোগ্যমূলক সেবা হিসাবে রাতকানা রোগে আক্রান্ত বাচ্চাদের চিহ্নিত করে চিকিৎসা প্রদান করা।

স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে আমাদের করণীয়

• স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাস ও পারিপার্শিক পরিচ্ছন্নতা লাভে উৎসাহ দান
• পানি দূষিত হওয়ার মূল কারণগুলো চিহ্নিতকরণ
• নিরাপদ পানি ব্যবহারে জনগণের উদ্বুদ্ধকরণ
• গর্ত ও প্রসবকালীন যত্ন সম্বন্ধে শিক্ষাদান।
• খাদ্য রান্নার নিয়ম, প্রয়োজনুযায়ী খাওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে।
• শালদুধসহ বুকের দুধ খাওয়ানো সম্পর্কে উৎসাহ দান।
• শিশুদের খাবার তৈরী সম্পর্কে জ্ঞানদান।
• অপুষ্টির কারণ চিহ্নিতকরণ (বিশেষতঃ মহিলা ও মেয়ে শিশুদের)।
• শিশুদের (ছেলে বা মেয়ে) ডায়রিয়া হলে তাদের চিকিৎসা করা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে মা বাবাকে পরামর্শদান করতে হবে।
• ডায়রিয়া বা বমির কারণে গুরুতর অসুস্থ শিশুদের চিহ্নিত করে হাসপাতালে পাঠাতে হবে।
• ঘরে তৈরী তরল খাবার/খাবার স্যালাইন তৈরীর পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষাদান করতে হবে।
• ডায়রিয়ার কারণ সম্বন্ধে জ্ঞানদান করতে হবে।
• জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের সেবা করতে হবে।
• যক্ষ্মা কিভাবে ছড়ায়, সেই সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
• খুজলি পাঁচড়ার রোগীদের চিহ্নিতকরণ ও সেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
• পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
• রাতকানা রোগে আক্রান্ত শিশু চিহ্নিত করে চিকিৎসা করাতে হবে।
• অপুষ্টিজনিত অন্ধত্ব ও তার রোধ সম্পর্কে জ্ঞান খাকতে হবে।
• এলাকার সব শিশুদের ভিটামিন 'এ' ক্যাপসুল খাওয়াতে হবে।
• শিশুদের রোগ প্রতিষেধক টিকাদানে এলাকাবাসীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
• টিকাদান কেন্দ্রে রোগ প্রতিষেধক টিকা প্রদান করতে হবে।
• আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়ার বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করতে হবে।
• সমাজের সকলকে শিশুদের মানসিকভাবে সুস্থ করে গড়ে তোলার পরামর্শ প্রদান করতে হবে।
• অবিবাহিত ও বিবাহিত দম্পতিদের ও প্রাপ্ত বয়স্ক সকলের সাথে প্রাণঘাতী রোগ এইডস প্রতিরোধের উপায়সমূহ সম্পর্কে সচেতন করা।
• সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে বিয়ে ও দাম্পত্যজীবন পালন করার উপর গুরুত্ব প্রদান করার জন্য উদ্বুদ্ধকরণ।
• পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির মধ্যে একমাত্র কনডম ব্যবহারের মাধ্যমে ভয়াবহ এইডস প্রতিরোধ করা যায় সে সম্পর্কে সচেতন করা।
তথ্যসুত্রঃ (পরিবার কল্যাণ সহকারী এবং পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক) সহায়িকা

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url