পুষ্টির অভাবজনিত রোগ-আয়োডিনের অভাবে কোন রোগ হয়
পুষ্টির অভাব বা অপুষ্টি বাংলাদেশের একটি মারাত্মক জাতীয় সমস্যা। এই সমস্যার
অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য, খাদ্য ঘাটতি, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে
অজ্ঞতা এবং নানা রকম কুসংস্কার। এচাড়াও দেশের আর্থ- সমাজিক কারণে অধিক সংখ্যক
মানুষ, গর্ভবতী ও প্রসুতি মহিলা এবং বাড়ন্ত শিশুরা সহজেই অপুষ্টিতে আক্রান্ত
হচ্ছে।
সুচিপত্রঃ- পুষ্টির অভাবজনিত রোগ-আয়োডিনের অভাবে কোন রোগ হয়
- অপুষ্টিজনিত রোগসমূহ
- গা-ফোলা (কোয়াশিয়রকর)
- ম্যারাসমাস বা হাড্ডিসার রোগ
- হাড্ডিসার (ম্যারাসমাস) ও গা-ফোলা (কোয়াশিয়রকর) এর পার্থক্য
- রাতকানা (নাইট ব্লাইন্ডনেস)
- মুখের বা ঠোঁটের কোনায় ঘা ( এঙ্গুলার ষ্টামাটাইটিস)
- রিকেটস
- রক্তাল্পতা (নিউট্রিশনাল এনিমিয়া)
- স্কার্ভি
- মানব দেহে আয়োডিনের প্রয়োজনীয়তা
- আয়োডিনের অভাব জনিত রোগ
- আয়োডিনের অভাবে কোন রোগের প্রতিরোধ
অপুষ্টিজনিত রোগসমূহ
সঠিক ও পরিমিত পুষ্টি উপাদানের অভাবে বিভিন্ন বয়সের মানুষ নানা রকম অপুষ্টিজনিত
রোগ ভুগে থাকে। সময়মত সঠিক চিকিৎসা না হওয়ার কারণে শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয়ের
সৃস্টি হয়, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরণের অপুষ্টিজনিত রোগের
মধ্যে আমিষ ও শক্তির অভাবজনিত রোগ বেশী দেখা দেয়। আমিষ ও শক্তির অভাব দেখা দেওয়ার
পাশাপাশি অন্যান্য পুষ্টি উপাদানেরও ঘাটতি দেখা দেয়, ফলে অপুষ্টি প্রকট আকার ধারণ
করে। আমাদের দেশে দেখা যায় এমন কিছু অপুষ্টজনিত রোগ নিম্নে বর্ণনা করা হলো।
১। আমিষ শক্তির ঘাটতিজনিত অপুষ্টি (প্রোটিন এনার্জি ম্যালনিউট্রিশন)ক) কোয়াশিয়রকর বা গা ফোলা রোগ
খ) ম্যারাসমাস বা হাড্ডিসার রোগ
২। হাড্ডিসার (ম্যারাসমাস)
৩। রাতকানা (নাইট ব্লাইন্ডনেস)
৪। মুখের বা ঠোঁটের কোনায় ঘা ( এঙ্গুলার ষ্টামাটাইটিস)
৫। রিকেটস
৬। রক্তাল্পতা( নিউট্রিশনাল এনিমিয়া)
৭। স্কার্ভি
গা-ফোলা (কোয়াশিয়রকর)
কোয়াশিয়রকর শব্দটি আফ্রিকার গোল্ড কোষ্টের একটি স্থানীয় শব্দ। এটি
আমিষ-শক্তি-ঘাটতি জনিত রোগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য একটি লক্ষণ (Syndrome) হিসাবে
ব্যবহৃত হয়। এতে শিশুর ওজন কমে যায় কিন্তু বয়সের তুলনায় আদর্শমানের শতকরা ৬০
ভাগের উপরে থাকে। বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। পায়ে পানি থাকে (শোথ বা ইডিমা)। মারাত্মক
ক্ষেত্রে শরীরের অন্যান্য অংশেও বিশেষ করে চিবুকে, চোখের পাতায় ও পেটে পানি জমে
উঠে। এ রোগে সাধারণত শিশু খাদ্যে আমিষ এর স্বল্পতা ঘটে। বয়স সাধারণত- ১ থেকে ৪
বৎসর বয়সের শিশুরা বেশী আক্রান্ত হয়।
কোয়াশিয়রকর রোগের কারণসমূহঃ১. খাবারে আমিষ এর স্বল্পতা হলে।
২. অস্ত্রের প্রদাহ, হাম, প্রভৃতি রোগে কোয়াশিয়রকর এ শিশুরা আক্রান্ত বেশী হয়।
কোয়াশিয়রকর রোগের লক্ষণঃ
- শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়।
- ত্বকের পরিবর্তন। ত্বকের বহিরাবরণ পাতলা দেখায়। ত্বক ফেটে যেতে পারে এবং ক্ষতের সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে যে সব জায়গায় অহরহ ঘসা লাগে সেখানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। যেমন- নিতম্ব, হাতের কনুই।
- সমস্ত শরীর বিশেষতঃ হাত,পা এবং মুখমন্ডলে পানি বা রস জমা হয়ে ফুলে যায়, মুখমন্ডল দেখতে গোলাকার এবং ফ্যাকাশে দেখায়।
- চুল পাতলা ও সরু হয়, পরবর্তীতে চুল পড়ে কমে যায়। চুলের রং পরিবর্তন হয়ে বাদামী বা ধুসর হয়ে যায়।
- মাংসপেশী শীর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু শোথ বা পানিতে ফুলে যাওয়ার কারণে শীর্ণকায় অবস্থাটি অনেক ক্ষেত্রে ধরা যায় না। শুধু বুক ও বাহু দেখে হাড্ডিসার বুঝা যায়।
- শিশুর মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়, শিশু সর্বদাই বিসন্ন, নিস্পৃহ এবং উদাসীন থাকে, কোন কিছুতেই তার আগ্রহ থাকে না বরং বিরক্ত হয়।
- স্থানে স্থানে লালচে ( ফ্লাকী পেইন্ট) চর্মরোগের সৃষ্টি হয়।
- রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
- অনেক ক্ষেত্রেই যকৃতের আকার বৃদ্ধি পায়।
- প্রায়ই ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা হয় এবং মলে খুব দুর্গন্ধ হয়।
- গা ফোলা শিশুদের সাধারণতঃ অন্যান্য অপুষ্টির চিহ্নও দেখা দিতে পারে। যেমন রক্তস্বল্পতা, জিহ্ববা এবং ঠোটের কোনায় ঘা ইত্যাদি।
- বয়স অনুযায়ী শিশুর ওজন ও বৃদ্ধি কমে যায়।
- শিশুকে উদাসীন ও দুর্দশাগ্রস্থ দেখায় এবং কোন কিছুর ব্যাপারেই সে উৎসাহ বোধ করে না।
- ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়।
কোয়াশিয়রকর রোগে আক্রান্ত শিশুকে আমিষের ঘাটতি পূরণের জন্য উৎকৃষ্ট আমিষ সমৃদ্ধ
খাদ্য যেমন- দুধ, ডিম, ননী তোলা গুড়াদুধ ইত্যাদি অধিক পরিমানে খাওয়াতে হবে। তবে
খেয়াল রাখতে হবে, আমিষ সমৃদ্ধ খাবার এমন হতে হবে যেন শিশু তার প্রতি কিলোগ্রাম
ওজনের বিপরীতে ৩০২ গ্রাম আমিষ উপাদান পেতে পারে। শিশুর ডায়রিয়া থাকলে নিয়মিত
খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগ থাকলে ডাক্তারের
তত্বাবধানে বা হাসপাতালে ভর্তি করে জরুরী চিকিৎসা করাতে হবে। আমিষ জাতীয় খাদ্যের
অভাবে যেহেতেু কোয়াশিয়রকর রোগটি হয়ে থাকে, সেহেতু রোগীকে প্রচুর পরিমাণে
শক্তিদায়ক এবং আমিষ জাতীয় খাদ্য উপযোগী করে খাওয়াতে হবে। তাতেও উন্নতি না হলে
ডাক্তারের পরামর্শমত চিকিৎসা করাতে হবে। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। তাই
শিশুদেরকে ম্যারাসমাস, কোয়াশিয়রকর এবং ম্যারাসমিক- কোয়াশিয়রকর ইত্যাদি রোগ থেকে
রক্ষা করতে হলে প্রথম থেকেই প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সে জন্য জন্মের
পর থেকেই ২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকে অবশ্যই মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে এবং
শিশুর বয়স ৫ বছর হলে মায়ের দুধের পাশাপাশি শর্করা ও আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য
যথেষ্ট পরিমাণে উপযোগী করে খাওয়াতে হবে।
হাড্ডিসার (ম্যারাসমাস)
হাড্ডিসার বা ম্যারাসমাস জাতীয় অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুরা সামগ্রিকভাবে শুকিয়ে
যায় বা শীর্ণকায় হয়ে যায়। খাদ্যে ক্যালরীর স্বল্পতার কারণে শিশু ম্যারাসমাস নামক
অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়। সাধারণত ১ বৎসরের কম বয়সের শিশুরা বেশী আক্রান্ত হয়ে
থাকে।
ম্যারাসমাস বা হাড্ডিসার রোগের কারণসমূহঃ১. পুষ্টি উপাদান এর অভাব বিশেষ করে, শর্করা ও আমিষের স্বল্পতা
২. উপর্যুপরি শ্বাসতন্ত্র ও অস্ত্রের সংক্রমণ যেমন এআরআই হাম, ডায়রিয়া ইত্যাদি।
৩. অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও কৃত্রিমভাবে বোতল ফিডিং (Bottle Feeding) করানো।
ম্যারাসমাস বা হাড্ডিসার রোগের লক্ষণঃ
সাধারণত এক বৎসরের নীচের বয়সী শিশুদের মধ্যেই এ রোগের প্রকোপ বেশী দেখা যায়। এ
রোগ হলে শরীর ক্রমশঃ রোগা হয়ে শীর্ণকায় বা হাড্ডিসার বা কঙ্কালসার হয়ে যায়।
ম্যারাসমাসের লক্ষণ হলঃ
- শিশুর শরীর বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, অর্থাৎ বয়স অনুপাতে বৃদ্ধি হয় না।
- বয়সের তুলনায় শিশুর ওজন শতকরা ৬০ ভাগের নীচে নেমে যায়।
- শরীরের সঞ্চিত চর্বি জাতীয় পদার্থ নিঃশেষ হয়ে যায় এবং মাংসপেশী শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে যায়। এ জন্য হাত পা সরু দেখায়। দেহ কঙ্কালসার দেখায়। চোয়ালের হাড় বেরিয়ে আসে। মুখাবয়ব চিন্তাক্লিষ্ট বৃদ্ধের মত দেখায়।
- দেহের চামড়া বিশেষ করে নিতম্ব ও উরুর চামড়া ঢিলে হয়ে যায় ও কুঁচকে যায়।
- পেট বড় হয়ে যায়।
- শিশুর মেজাজ খিট খিটে হয়ে যায়।
- ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা হতে পারে।
- কোন কোন ক্ষেত্রে রক্তস্বল্পতাও দেখা দিতে পারে।
- শিশুর ক্ষুধা খুব বেশী হয়, কেবল খেতে চায়।
- মাথার চুল পাতলা হয়ে যায়। অনেক সময় চুল উঠে যায়।
- পায়ে পানি (শোথ) থাকবে না।
- ক্ষুধামন্দা।
ম্যারাসমাস রোগে আক্রান্ত শিশুকে, শরীরের ওজন বাড়ানো এবং দ্রম্নত বৃদ্ধির
জন্যে প্রচুর পরিমাণে উচ্চ পুষ্টিমানের শক্তিদায়ক এবং আমিষ জাতীয় খাদ্য উপযোগী
করে বারে বারে খাওয়াতে হবে। ডায়রিয়া বা কৃমি বা অন্যান্য সংক্রামক রোগ থাকলে
ডাক্তারের পরামর্শমত খাবার স্যালাইন বা অন্যান্য ঔষধও খাওয়াতে হবে। মারাত্মক
অবস্থায় হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করাতে হবে। একবার রোগী ভাল হওয়ার পর পুনরায়
যাতে আক্রান্ত হতে না পারে, সে জন্যে পর্যাপ্ত খাদ্যের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে
হবে।
হাড্ডিসার (ম্যারাসমাস) ও গা-ফোলা (কোয়াশিয়রকর) এর পার্থক্য
উপসর্গ | হাড্ডিসার | গা-ফোলা |
---|---|---|
১. দেহের বৃদ্ধি | ব্যাহত হয় | ব্যাহত হয় |
২. দেহের ওজন | বয়সের তুলনায় কম | বয়সের তুলনায় কম |
৩. মাংসপেশী | শীর্ণ হয়ে যায় | শীর্ণ হয়ে যায় |
৪. মানসিক অবস্থা | অস্থির এবং দুর্দশাগ্রস্ত | উদাসীন এবং দুর্দশাগ্রস্ত |
৫. ত্বকের পরিবর্তন | সাধারণতঃ হয় না, তবে চামড়া ঢিলা হয়ে ভাঁজ পড়ে | কখনও কখনও ত্বকের পরিবর্তন দেখা দেয়। ত্বকে ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে। |
৬. চুলের পরিবর্তন | পাতলা হয় | পাতলা হয়ে কমে যায় এবং চুলের রং বাদামী হতে পারে |
৭. ইডিমা বা পায়ে পানি জমা | ইডিমা থাকে না | ইডিমা থাকে |
৮. বয়সের তুলনায় ওজন (বয়স/ওজন) | ৬০% নিচে | ৬০% উপরে |
রাতকানা (নাইট ব্লাইন্ডনেস)
শিশুদের অন্যতম প্রধান একটি রোগ হলো রাতকানা বা নাইট ব্লাইন্ডনেস। বাংলাদেশের
অনেক শিশুই রাতকানায় ভোগে থাকে। যাদের বয়স ৬ মাস থেকে ৬ বছর তাদের মধ্যে
রাতকানা রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। প্রতি বছর প্রায় ৫ লক্ষ শিশু
রাতকানা রোগে ভোগে যাদের বয়স মাত্র ৬ বছর বা তার নিচে। এবং প্রায় ৩০,০০০ জন
শিশু পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায়। এদেরে মধ্যে প্রায় অর্ধেকই আবার আমিষ এর অপুষ্টি
জনিত কারণে প্রথম বছরই মারা যায়।
রাতকানা রোগের লক্ষণঃ
রাতে বা কম আলোতে চোখে কম দেখাকেই রাতকানা রোগ বলে। রাতকানা হওয়ার পূর্বে এবং
পরে কতগুলো লক্ষণ পর্যায়ক্রমে দেখা দেয়। যেমন-
১) চোখ লাল হয়ে যায়।২) চোখের সাদা অংশের রং পরিবর্তন হয়ে বাদামী হয়ে যায়;
৩) চোখে ফুলি পড়ে (বিটট স্পট)।
৪) চোখের পানি কমে গিয়ে সাদা অংশ শুষ্ক হয়ে যায়;
৫) অল্প আলোতে চোখে ঝাপসা বা কম দেখে;
৬) উজ্জ্বল আলোর দিকে সরাসরি তাকাতে পারে না;
৭) চোখের মনিতে ঘা হয়ে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায়।
রাতকানা রোগের কারণঃ
রাতকানা রোগের প্রধান কারণ হলো ভিটামিন ‘এ’। শিশুকে মায়ের দুধ না খাওয়ালে,
বাড়তি খাবারে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাদ্য কম বা না থাকলে, শিশুর স্বাভাবিক খাবারে
ভিটামিন ‘এ’ এর পরিমাণ কম থাকলে ভিটামিন ‘এ’ এর ঘাটতি দেখা দেয় এবং শিশু
রাতকানা রোগে আক্রান্ত হয়।
রাতকানা রোগের প্রতিকারঃ
রাতকানা রোগে আক্রন্ত হলে শিশুকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাবার
খাওয়াতে হবে। ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাবার গুলো হচ্ছে কলিজা, মাছের তেল, ডিম, মাখন
এবং গাঢ় রঙ্গিন শাক সবজি ও ফলমূল ইত্যাদি। শাক সবজি রান্নার সময় পরিমান মত অবশ্যই
তেল ব্যবহার করতে হবে। শিশুকে অবশ্যই ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়াতে হবে। ক্যাপসুল
খাওয়ানোর নিয়ম প্রথম দিন ১টি, দ্বিতীয় দিন ১টি এবং ১৪ দিন পর আরও একটি ভিটামিন
‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়াতে হবে। প্রতিদিন শাক সবজি ও ফলমূল খেলে এবং ৬ মাস পর পর একটি
করে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ালে শিশুদের রাতকানা প্রতিরোধ করা যায়।
মুখের কোনায় ঘাঁ
মুখের বা ঠোঁটের কোনায় ঘা হওয়াকে এংগুলার ষ্টোমাটাইটিস বলে।লক্ষণঃ
বাংলাদেশে শীতকালে বিশেষতঃ গ্রামাঞ্চলে অনেকেরই ঠোঁটের কোনায় এবং জিহব্বায় ঘা
দেখা দেয়। এ রোগের লক্ষণ হল-
১) ঠোঁট লাল হয়ে ফেটে যায়।২) মুখের বা ঠোঁটের দুই কোনায় ঘা হয়, কস পরে এবং হা করা যায় না।
৩) জিহব্বায় ঘা হয়, লাল হয়ে ফুলে যায়, ব্যথা হয় এবং খেতে অসুবিধা হয়।
কারণঃ
শরীরে ভিটামিন ‘বি২’ বা রাইবোফ্লাভিনের অভাবে এই রোগ হয়ে থাকে। সাধারণত দুধ, ডিম,
ডাল, কলিজা, সিদ্ধচাল এবং শাক সবজি প্রয়োজনীয় পরিমাণে না খেলে এ রোগ হয়।
প্রতিকারঃ
নিয়মিত ভিটামিন ‘বি২’ বা রাইবোফ্লাভিন যুক্ত খাবার খেতে হবে। প্রচুর পরিমানে দুধ,
ডিম এবং শাক সবজি খেতে হবে। মুখে অতিরিক্ত ঘা দেখা দিলে সাথে সাথে ভিটামিন ‘বি২’
ট্যাবলেট একটি করে দিনে ৩ বার খেতে হবে। এই রোগ প্রতিরোধ করতে হলে প্রতিদিন দুধ,
ডিম ও শাক সবজি প্রয়োজনীয় পরিমাণে খেতে হবে।
রিকেটস
বাংলাদেশে রিকেটস রোগের প্রকোপ তুলনা মুলক অনেক কম। ভিটামিন ‘ডি’ এর অভাবে এই রোগ
হয়ে থাকে। সাধারণত যে সব এলাকায় সূর্যের আলো কম পৌঁছায় যেমন- ঘনবসতি বা বস্তি
এলাকা এবং ভিটামিন ‘ডি’ এবং ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার, সে এলাকায় বিশেষতঃ ছোট
শিশুদের রিকেটস রোগ বেশী হয়ে থাকে।
রিকেটস রোগের লক্ষণঃ
১) শিশু প্রায়ই কাঁদে এবং অস্থির থাকে।২) শিশুর দাঁত উঠতে দেরী হয়।
৩) শিশুর হাড়ের গঠন ঠিকমত হয় না এবং হাত ও পায়ের হাড় বাকা হয়ে যায়।
৪) শিশু ঠিকমত এবং সময়মত বসতে, উঠতে, হামাগুড়ি দিতে, দাঁড়াতে এবং হাঁটতে পারে না।
রিকেটস রোগের কারণঃ
ভিটামিন ‘ডি’এর অভাব হলে এবং ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে ক্যালসিয়াম শরীরে শোষিত হতে না
পারলে রিকেটস হয়।
রিকেটস রোগের প্রতিকারঃ
প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ‘ডি’ এবং সাথে সাথে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
এছাড়াও শিশুর শরীরে ভিটামিন ‘ডি’ তৈরি করার জন্য শিশুকে প্রতিদিন কিছু সময়ের
জন্যে খালি গায়ে রৌদ্রে রাখতে হবে।
রক্তসল্পতা (নিউট্রিশনাল এনিমিয়া)
রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে যাওয়াকে রক্তসল্পতা বলা হয়। গর্ভবতী, প্রসূতি
মহিলা এবং ছোট শিশুরা সহজে এ রোগে আক্রন্ত হয়। এ রোগে আক্রান্ত হলে ধীরে ধীরে
শরীর নিস্তেজ হয়ে যায় , কর্মক্ষমতা লোপ পায় এবং বিভিন্ন সংক্রামক রোগ সহজেই দেহকে
আক্রমন করতে পারে।
রক্তাল্পতার লক্ষণঃ১) শরীর বিশেষত মুখমন্ডল ফ্যাকাশে বা সাদা হয়ে যায়।
২) শরীর দুর্বল হয়ে যায় বলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালে মাথা ঘুরায় এবং বমি ভাব হয়;
৩) সামান্য কাজ করলেই ক্লান্ত হয়ে যায় এবং হাঁপাতে থাকে।
৪) বুক ধড়ফড় করে।
৫) শ্বাস কষ্ট হয়।
৬) জিহ্বা মসৃন এবং সাদা হয়ে যায়;
৭) চোখের কোটরির উপরের শিরাগুলোর রক্ত হালকা লাল বর্ণের হয়ে যায়।
৮) মারাত্বক রক্তসল্পতায় হাতের নখ চা চামচের ন্যায় উপরের দিকে উল্টে যায় এবং
শরীরে পানি জমা হতে পারে।
রক্তাল্পতার কারণঃ
শরীরে লৌহের ঘাটতি হলে রক্তাল্পতা দেখা দেয়। আবার আমিষের অভাব হলে শরীরে প্রয়োজন
মত রক্ত তৈরি হয় না ফলে রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও কৃমিতে আক্রান্ত হওয়া,
দুর্ঘটনায় অত্যধিক রক্তক্ষরণ হওয়া, গর্ভাবস্থায় এবং বাচ্চা প্রসবের পর পরিমান মত
লৌহ সমৃদ্ধ খাবার না খাওয়া রক্তসল্পতার অন্যতম কারণ।
রক্তাল্পতার প্রতিকারঃ
রক্তাল্পতার প্রতিকারে জন্য প্রাথমিক অবস্থায় প্রচুর পরিমাণে লৌহ সমৃদ্ধ ও আমিষ
জাতীয় খাদ্য এবং সাথে সাথে ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ টক জাতীয় ফল খেতে হবে। শরীরে কৃমি
থাকলে তার চিকিৎসা করতে হবে। রক্তাল্পতা মাত্রাতিরিক্ত হলে লৌহ ও আমিষ সমৃদ্ধ
খাবার খাওয়ার পাশাপাশি অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। প্রতিদিন পরিমান মত
শাক-সবজি তথা সুষম খাদ্য খেলে রক্তাল্পতা রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
স্কার্ভি
যে কোন বয়সের মানুষ স্কার্ভি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বাংলাদেশে এ রোগের প্রকোপ খুব কম।স্কার্ভি রোগের লক্ষণঃ
১) দাঁতের মাড়ি লাল হয়ে ফুলে যায়।
২) সামান্য আঘাতের ফলেই দাঁতের গোড়া দিক্ত বের হয়।
৩) দাঁতের গোড়া মাড়ি থেকে আলগা হয়ে যায় ফলে দাঁত নড়ে, মাড়িতে ঘা ও পুঁজ হয়।
৪) চামড়ার নীচে রক্তক্ষরণ দেখা দেয়।
স্কার্ভি রোগের কারণঃ
এ রোগের প্রধান কারণ হলো ভিটামিন ‘সি’ এর অভাব। দীর্ঘদিন ধরে খাবারে ভিটামিন ‘সি’
এর অভাব থাকলে স্কার্ভি রোগ হয়।
স্কার্ভি রোগের প্রতিকারঃ
স্কার্ভি রোগ হলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। দাঁতের
মাড়িতে ঘা এর মাত্র বেশী হলে এবং বেশি রক্ত ঝরলে ফল খাওয়ার পাশাপাশি ভিটামিন ‘সি’
ট্যাবলেট খেতে হবে। স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধ করতে হলে প্রতিদিন সুষম খাবারের
পাশাপাশি অন্তত দুই একটি ফল অবশ্যই খেতে হবে।
মানব দেহে আয়োডিনের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশে আয়োডিনের অভাবজনিত সমস্যা
বাংলাদেশে আয়োডিনের অভাব অনেক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ। আয়োডিন ঘাটতির একটি অন্যতম
লক্ষণ হলো গলগন্ড বা ঘ্যাগ। ১৯৯৩ সালে জরীপে দেখা গেল বাংলাদেশে পাঁচ কোটির বেশী
লোক গলগন্ড রোগে ভুগছে। আট কোটি লোকের মধ্যে আয়োডিনের অভাব রয়েছে। পাঁচ লক্ষের
বেশী লোকের মধ্যে রয়েছে মারাত্মক স্নায়ুর ত্রুটিজনিত সমস্যাবলী। আয়োডিনের অভাবে
লক্ষ লক্ষ লোক বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক অসুস্থতায় ভুগছে।
মানব দেহে আয়োডিনের প্রয়োজনীয়তা কি?
মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আয়োডিন দরকার। প্রয়োজনীয়
আয়োডিনের অভাবে শিশু মানসিক প্রতিবন্ধী ও বিকলাঙ্গ হয়। শিশু বোবা-কালা এবং চোখ
ট্যারা হয়, শিশুর স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আয়োডিনের অভাবে গর্ভপাতও হয়ে
থাকে। যদি একজন গর্ভবতী মায়ের আয়োডিনের অভাব হয় তাহলে তার সন্তানেরও আয়োডিনের
অভাব হবে। সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতি হয় গর্ভস্থ ভ্রুণ ও নবজাত শিশুর মস্তিস্কের।
গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের প্রকট আয়োডিনের অভাব হলে সন্তানের মস্তিষ্ক
স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠতে পারে না। অনেক সময় শিশু জন্মের আগেই মারা যায়, যদি শিশুটি
বেঁচেও যায় তাহলে সে হয় হাবাগোবা ও নির্বোধ। সে ভুগবে নানা রকম শারীরিক ও মানসিক
সমস্যায়, যার কোন প্রতিকার নেই। এমন কি পশু-পাখিদের বেলায় আয়োডিনের অভাব হলে
প্রাণী আকারে ছোট হয়, মাংস, দুধ, ডিম ইত্যাদি কম হয়। গরীব-ধনী, গ্রামবাসী-শহরবাসী
নির্বিশেষে যে কারো আয়োডিনের অভাবজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। সারা দেশেই খাদ্যে
আয়োডিনের ঘাটতি দেখা গেছে। জরীপে আরো দেখা গেছে, আয়োডিনের ঘাটতি জনিত সমস্যা এখন
বাংলাদেশের সর্বত্রই প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
আয়োডিনের অভাব জনিত রোগ
(ক) গলগন্ড হয়।(খ) শিশু হাবাগোবা হতে পারে।
(গ) বামন হতে পারে।
(ঘ) ট্যারা চোখ হতে পারে।
(ঙ) বোবা হতে পারে।
তাছাড়া গর্ভবতী মায়েদের খাদ্যে আয়োডিনের অভাব হলে
- গর্ভপাত হতে পারে।
- মৃত শিশুর জন্ম হতে পারে।
- বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে।
আয়োডিনের অভাবে কোন রোগের প্রতিরোধ
খাদ্যে অবশ্যই বাড়তি আয়োডিনযুক্ত লবণ খেতে হবে।আয়োডিনযুক্ত লবণের ব্যবহার
- যে ভাবে আমরা সাধারণ লবণ গ্রহণ করি ঠিক সেভাবে আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ এই লবণ রান্নায় এবং খাবারে ব্যবহার করতে হবে।
- আয়োডিনযুক্ত লবণ কাচের বয়াম, মাটি বা প-াষ্টিকের পাত্রে ঢেকে রাখতে হবে। এই লবণ রোদে কিংবা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় রাখলে লবণে আয়োডিনের পরিমাণ কমে যেতে পারে। লবণ ধুয়ে নিলেও আয়োডিনের পরিমাণ কমে যাবে।
এ ছাড়া ইনজেকশন ও খাওয়ার ঔষধের মাধ্যমে আয়োডিন জনিত সমস্যার হাত থেকে রক্ষা
পাওয়া যায়।
তথ্যসুত্রঃ
সমন্বিত ফলিত পুষ্টি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও
প্রশিক্ষণ ইনষ্টিটিউট (বারটান-BIRTAN), খামারবাড়ী, ঢাকা।
(পরিবার কল্যাণ সহকারী এবং পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক) সহায়িকা
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url