রোমান সভ্যতা - রোমান সভ্যতার ইতিহাস

প্রাচীন রোম পৃথিবীর সমৃদ্ধতম প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম যা খ্রিষ্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীর প্রথমভাগে ইতালীয় উপদ্বীপে সূচীত হয়। রোম শহরকে কেন্দ্র করে ভূমধ্যসাগরের তীর ধরে এই সভ্যতা বিকাশিত হতে থাকে, এবং কালক্রমে একটি প্রাচীন যুগের বৃহত্তম সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

এই সভ্যতার স্থায়ীত্বকাল ছিল প্রায় বারো শতক এবং এ দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় রোমান সভ্যতা একটি রাজতন্ত্র থেকে একটি সম্ভ্রান্ত প্রজাতন্ত্র এবং পর্যায়ক্রমে একটি একনায়কতন্ত্রী সাম্রাজ্যে পরিবর্তিত হয়। যুদ্ধ বিজয় এবং আত্তীকরণের মাধ্যমে এটি দক্ষিণ ইউরোপ, পশ্চিম ইউরোপ, এশিয়া মাইনর, উত্তর আফ্রিকা, উত্তর ইউরোপ এবং পূর্ব ইউরোপের একাংশকে এর শাসনাধীনে নিয়ে এসেছিল। রোম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাম্রাজ্য এবং প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সাম্রাজ্যগুলোর একটি ছিল। এটিকে প্রায়ই প্রাচীন গ্রিস সাথে একত্রে "উচ্চমানের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের" মধ্যে দলবদ্ধ করা হয় এবং এদুটি সভ্যতার সাথে অনুরূপ সংস্কৃতি ও সমাজ মিলে একত্রে গ্রেকো-রোমান বিশ্ব হিসাবে পরিচিত।

রোমান সাম্রাজ্য এর ইতিহাসঃ

রোমান সাম্রাজ্য (লাতিন: Imperium Rōmānum; ইম্পেরিউম্ রোমানুম্) প্রাচীন রোমান সভ্যতার একটি পর্যায়, সাম্রাজ্যটি একজন সম্রাটের নেতৃত্বে থাকা সরকারের দ্বারা পরিচালিত হত এবং রোমান সাম্রাজ্যের শাসনাধীন অঞ্চলসমূহ ভূমধ্যসাগরের চারিদিকে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। খ্রিঃপূঃ ১০০-৪০০ খ্রিঃ পর্যন্ত রোম পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম নগরী ছিল[৪], এবং রোমান সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ৫০-৯০ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছিল (যা তৎকালীন সময়ে পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ২০% ছিল)।[৫] এর আগে গৃহযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক সংঘাতের ফলে রোমে বিরাজমান ৫০০ বছরের রোমান প্রজাতন্ত্রে চরম অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। অস্থিরতার ঐ সময়ে জুলিয়াস সিজার কে স্থায়ী ডিক্টেটর বা ন্যায়পালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। খ্ৰী:পূ: ৪৪-তে তাকে কয়েকজন ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করে। ফলস্বরূপ গৃহযুদ্ধ এবং হত্যালীলা অব্যাহত থাকে। সিজারের পোষ্য পুত্র অক্টাভিয়ান খ্রী:পূ: ৩১-এ এক্টিয়ামের যুদ্ধে মার্ক এন্টনী এবং ক্লিওপেট্রাকে পরাজিত করে। এরপর অক্টাভিয়ান অদমনীয় হয়ে উঠে এবং খ্রী:পূ: ২৭-এ রোমান সিনেটে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অসীম ক্ষমতা দেয়ার সাথে আউগুস্তুস উপাধি প্রদান করে যা রোমান সাম্রাজ্যের শুরুর একটি মাইলফলক।


রোমান প্রজাতন্ত্র প্রায় ১৪০০ বছর ধরে প্রচলিত ছিল। এর প্রথম দুই শতক রাজনৈতিক সুস্থরতা এবং সমৃদ্ধির কারণে এদের “রোমান শান্তি”র যুগ হিসেবে অভিহিত করা হয়। অক্টেভিয়ানের বিজয়ের পর রোমান সাম্রাজ্যের পরিসর নাটকীয়ভাবে সম্প্রসারিত হয়। ৪১ সালে কেলিগুলার হত্যার পর সিনেটে পুনরায় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ইতোমধ্যে প্রেইটোরিয়ান দেহরক্ষী বাহিনী ক্লডিয়াসকে সম্রাট ঘোষণা করে। ক্লডিয়াসের নেতৃত্বে রোমানরা ব্রিটানিয়াকে নিজ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত করে। অক্টেভিয়ানের পর এটাই ছিল সর্ববৃহৎ রাজ্য বিস্তারের ঘটনা। ক্লডিয়াসের পরবর্তী সম্রাট নীরো ৬৮ সালে আত্মহত্যা করার পর পুনরায় রাজনৈতিক অস্থিরতার উদ্ভব হয়। গৃহযুদ্ধ এবং বিদ্রোহের (ইহুদী-রোমান যুদ্ধ) সময় চারজন সেনাধ্যক্ষক সম্রাট ঘোষণা করা হয়। ৬৯ সালে ভেসপাসিয়ানে বিজয় লাভ করে এবং ফ্লেভিয়ান রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করে। তার পুত্র পরবর্তী সম্রাট টাইটাসে রোমের বিখ্যাত কলোসিয়াম নির্মাণ করে। টাইটাসের অল্প সময়ের রাজত্যের পর তার ভাই ডমিটিয়ান রোমান সিংহাস করে এবং দীর্ঘকাল রাজত্বের পর হত্যার বলি হয়। এরপর সিনেট পাঁচজন সম্রাটকে বাছাই করে। এদ্বিতীয় সম্রাট ট্রাজানের শাসনামলে রোমান সাম্রাজ্র্বোচ্চ শিখরে উন্নীত হয়।


কমডাসরাজত্বকালে অস্থিরতা আর পতনোন্মুখ গতি পুনরায় আরম্ভ হয় এবং ১৯২ সালে তাকে হত্যা করা হয়, পঞ্সম্রাটের শাসনামলে। এরপর সেপ্টিমাস সেভেরাস সম্হয়। ২৩৫ সালে আলেকজান্ডার সেভেরাসের হত্যার পর রোমান রাজনৈতিক ক্ষেত্ৰে প্রবল অস্থিরতা সৃষ্টি হয় এবং রোমান সিনেটে মাত্র ৫০ বলোককে সম্রাট ঘোষণা করে। ডিয়ক্লেটিয়ানের শাসনকালে দেশ চার ভাগে ভাগ করে প্রত্যেকটি অংশে একজন নির্দিষ্ট শাসনকর্তা নিয়োগ করা হয় যার ফলস্বরূপ দেশে পুনরায় সুস্থিরতা আসলেও প্ৰথম কনষ্টেণ্টাইন এর শাসনকালে গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে এর অবসান ঘটে, এবং সকল প্রতিদ পরাভূত করে তিনি একছত্র সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। কনস্টেন্টাইন রোমান রাজধানী বাইজেন্টাইনে স্থানান্তর করেন এবং তার সন্মানার্থে কনষ্টাণ্টিনপল হিসেবে জায়গার নতুন নামাকরণ করা হয়। নগরীর পতন আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এটি ছিল প্রাচ্যের রাজধানী। তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করার পর রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে এটা গৃহীত হয়। সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চল(বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য) বিশ্বের এক অগ্রণী শক্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। সংযুক্ত রোমান সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট প্রথম থিয়ডসিয়া মৃত্যুর পর ক্ষমতার অপব্যবহার, গৃহযুদ্ধ, বহিরআগ্রাসন, অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা ইত্যাদি কারণে রোমান সাম্রাজ্যের আধিপত্য ক্ৰমশ হ্রাস পায় বলে মনে করা হয়। রোমান সাম্রাজ্য অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে সেই সময়কার সবথেকে শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধিশালী সাম্রাজ্যসমূহের অন্যতম ছিল। এটি ছিল প্রাচীন কালের এবং পৃথিবীর বৃহত্তম সাম্রাজ্যসমূহের একটি। ট্রাজানের সময়কালে এর আয়তন ছিল ৫০ লাখ বর্গ কিলোমিটার[২] , যা ২১ শতকের ৪৮ টি জাতিগোষ্ঠীর সম পর্যায়ের[৬][৭] এবং প্রায় ৭ কোটি লোকের বসবাস ছিল যা তৎকালীন বিশ্ব জনসংখ্যার ২১% ধারণ করছিল। রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি এবং স্থায়ীত্বই লেটিন এবং গ্রীক ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, আবিষ্কার, স্থাপত্য, দর্শন, আইন এবং সরকার গঠনের বিস্তৃতি এবং স্থায়ীত্ব নিশ্চিত করেছিল। 


রোমান সভ্যতা (The Roman Civilization)

প্রাচীনকালের অধিকাংশ সভ্যতা নদীমাতৃক হলেও রোমান সভ্যতা নদীমাতৃক ছিল না। ইতালির পশ্চিমাংশে অবস্থিত ছোট্ট শহর রোমকে কেন্দ্র করে রোমান সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। ইন্দো- ইউরোপীয় গোষ্ঠীর একদল মানুষ ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে উত্তর ইতালিতে বসতি গড়ে তোলে। এদের বলা হত ল্যাটিন। ক্রমে এদের ভাষা 'ল্যাটিন ভাষা' নামে পরিচিতি পায়। ল্যাটিন রাজা রোমিউলাস একটি নগরীর পত্তন করেন। রাজার নামেই নগরীর নাম হয় রোম। দাসশ্রমের উপর নির্ভরশীল ছিল রোমের অর্থনীতি। দাসদের উপর অমানবিক অত্যাচার করা হত। অবশেষে স্পার্টাকাস নামক একজন দাসের নেতৃত্বে সংঘটিত হয় দাস বিদ্রোহ। বিদ্রোহী দাসরা দুই বছর দক্ষিণ ইতালিতে টিকে ছিল। স্পার্টাকাস ৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নিহত হলে দাস বিদ্রোহের অবসান হয়। রোমের সবচেয়ে খ্যাতিমান সম্রাট ছিলেন জুলিয়াস সিজার। তিনি ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমের সম্রাট হন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি * এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। কিন্তু রোমে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও ষড়যন্ত্র প্রবল হতে থাকলে ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াস নামের দুই অভিজাতের হাতে জুলিয়াস সিজার নিহত হন। এবার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে রোম। অবশেষে তিন নেতা একযোগে ক্ষমতায় আসেন। এরা হলেন অক্টেভিয়াস সিজার, মার্ক এন্টনি এবং লেপিডাস। এ তিনজনের একত্র শাসনকে ইতিহাসে 'ত্রয়ী শাসন' বলা হয়। ত্রয়ী মিশরের রানী ক্লিওপেট্রা শাসন বেশিদিন টেকেনি। অক্টেভিয়াস সিজার প্রথমে পরাজিত করেন লেপিডাসকে। এন্টনি মিশরের রাজকন্যা ক্লিওপেট্রা-কে বিয়ে করে শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন। ক্লিওপেট্রাকে ইতিহাসে Serpent of the Nile (নীল নদের সর্প) নামে পরিচিত। কিন্তু তিনিও পরাজিত হন অক্টেভিয়াস সিজারের হাতে। এভাবে রোমান সম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে অক্টেভিয়াস সিজার অগাস্টাস সিজার উপাধি গ্রহণ করেন। অগাস্টাস সিজারের রাজত্বকালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যীশুখ্রিস্টের জন্ম। অগাস্টাস সিজার ১৪ সালে মারা যান। ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাজ্যের পতন হয় । শেষ রোমান সম্রাট ছিলেন রোমিউলাস অগাস্টুলাস।


সভ্যতায় রোমের অবদানঃ

 রোম শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, স্থাপত্য সর্বক্ষেত্রে গ্রিকদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল । তারা এসব বিষয়ে গ্রিকদের অনুসরণ ও অনুকরণ করেছে । তবে সামরিক সংগঠন, শাসন পরিচালনা, আইন ও প্রকৌশল বিদ্যায় তারা গ্রিক ও অন্যান্য জাতির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল । এ ক্ষেত্রে আধুনিক বিশ্ব রোমানদের কাছে ব্যাপক ঋণী ।

শিক্ষা, সাহিত্য ও লিখন পদ্ধতি : এ সময়ে শিক্ষা বলতে বুঝাতো খেলাধুলা ও বীরদের স্মৃতিকথা বর্ণনা করা । যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে রোমের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সুতরাং তাদের সব কিছুই ছিল যুদ্ধকে কেন্দ্ৰ করে । তারপরও উচ্চ শ্রেণিভুক্ত রোমানদের গ্রিক ভাষা শিক্ষা ছিল একটি ফ্যাশন । ফলে এদের অনেকেই গ্রিক সাহিত্যকে লাতিন ভাষায় অনুবাদ করার দক্ষতা অর্জন করে । রোমের অভিজাত যুবকরা গ্রিসের বিভিন্ন বিখ্যাত বিদ্যাপীঠে শিক্ষালাভ করতে যেত । সে যুগে সাহিত্যে অবদানের জন্য প্লুটাস ও টেরেন্সর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা দু'জন মিলনাত্মক নাটক রচনার ক্ষেত্রে কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন । সাহিত্য ক্ষেত্রে সবচেয়ে উন্নতি দেখা যায় অগাস্টাস সিজারের সময় । এ যুগের কবি হোরাস ও ভার্জিল যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন । ভার্জিলের মহাকাব্য 'ইনিড’ বহু ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে । ওভিদ ও লিভি এ যুগের খ্যাতনামা কবি । লিভি ইতিহাসবিদ হিসেবেও বিখ্যাত ছিলেন । বিখ্যাত ঐতিহাসিক ট্যাসিটাসও এ যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ।


দর্শন

রোমের সবচেয়ে জনপ্রিয় দার্শনিক মতবাদের নাম 'স্টোয়িকবাদ'। এ দর্শনের উন্নয়নের পিছনে তিন ব্যক্তির বিশেষ ভূমিকা ছিল। এরা ছিলেন ধনী রোমান 'সেনেকা', অন্যজন এক দাস 'এপিকটেটাস' এবং শেষ ব্যক্তিত্ব হলেন রোমান সম্রাট 'মার্কাস অরেলিয়াস।

সাহিত্য

এ যুগের কবি হোরাস ও ভার্জিল যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ভার্জিলের মহাকাব্য 'ইনিঃ" বহুভাষায় অনূদিত হয়েছে। ওভিদ ও লিভি এ যুগের অন্য দুই খ্যাতিমান কবি। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাস এ যুগে রোমে জন্ম নিয়েছিলেন।


স্থাপত্য ও ভাস্কর্য

রোমের একটি বিখ্যাত স্থাপত্য নিদর্শন হচ্ছে সম্রাট হাড্রিয়ানের তৈরি ধর্মমন্দির প্যানথিয়ন। কলোসিয়াম নামে রোমে তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় নাট্যশালা তৈরি হয়েছিল। এখানে একসাথে ৫৬০০ দর্শক বসতে পারত।

রোমান স্থাপত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এর বিশালতা। সম্রাট হার্ডিয়ানের তৈরি ধর্মমন্দির প্যানথিয়ন রোমানদের স্থাপত্যের এক অসাধারণ নিদর্শন। ৮০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট টিটাস কর্তৃক নির্মিত কলোসিয়াম নাট্যশালা নির্মিত হয়, যেখানে একসঙ্গে ৫৬০০ দর্শক বসতে পারত। স্থাপত্যকলার পাশাপাশি রোমান ভাস্কর্যেরও উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। রোমান ভাস্করগণ দেব-দেবী, সম্রাট, দৈত্য, পুরাণের বিভিন্ন চরিত্রের মূর্তি তৈরি করতেন মার্বেল পাথরের। বিজ্ঞানীদের মধ্যে কেউ কেউ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হন। তাদের মধ্যে প্লিনি বিজ্ঞান সম্পর্কে বিশ্বকোষ প্রণয়ন করেন। এতে প্রায় পাঁচশ বিজ্ঞানীর গবেষণাকর্ম স্থান পেয়েছে। তাছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোমানদের অবদান ছিল। বিজ্ঞানী সেলসাস চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর বই লেখেন। এছাড়া চিকিৎসাশাস্ত্রে গ্যালেন রুফাসে অসামান্য অবদান রেখেছেন।


আইন

রোমানদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব আইনের ক্ষেত্রে। বার্জেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ রোমান আইন সংকলিত করেন। আইনের ক্ষেত্রে আধুনিক বিশ্ব সম্পূর্ণভাবে রোমান আইনের উপর নির্ভরশীল।


ধর্ম, দর্শন ও আইন

রোমানরা ধর্মীয় ক্ষেত্রেও গ্রিকদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। অনেক গ্রিক দেব-দেবীর নাম পরিবর্তন হয়ে রোমানদের দেব-দেবী হয়েছে । রোমানদের অন্যতম প্রধান দেবতার নাম ছিল জুপিটার। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দেব-দেবী হচ্ছে জুনো, নেপচুন, মাস, ভলকান, ভেনাস, মিনার্ভা, ব্যাকাস ইত্যাদি। রোমান দেবমন্দিরে প্রধান পুরোহিত ছিলেন যাঁরা, তাঁরা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন । তবে রোমানদের পরকালের প্রতি বিশ্বাস ছিল না। অগাস্টাস সিজারের সময় থেকে ঈশ্বর হিসেবে সম্রাটকে পূজা করার রীতি চালু হয়। উল্লেখ্য, এ সময় খ্রিষ্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিষ্টের জন্ম হয়। পরবর্তীকালে রোমান ধর্মের পাশাপাশি খ্রিষ্টধর্ম বিস্তার লাভ করতে থাকে। অনেক রোমান এই ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে। এতে সম্রাট ক্ষুব্ধ হন কারণ খ্রিষ্টধর্মের অনুশাসন মেনে চলতে গেলে সম্রাটকে আর ঈশ্বরের মতো পূজা করা যায় না। ফলে রোমান সম্রাটরা এই ধর্ম প্রচার বন্ধ করে দেন এবং খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণকারী রোমানদের ওপর নির্যাতন শুরু করেন। কিন্তু সম্রাট কন্সটানটাইন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং এই ধর্মকে রোমান সরকারি ধর্মে পরিণত করেন ।

অনেকে মনে করেন যে, রোমীয় দর্শন গ্রিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। তবুও রোমান দর্শনে সিসেরো লুক্রেটিয়াস (খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ৯৮-৫৫) তাঁদের সুচিন্তিত দার্শনিক মতবাদ দ্বারা অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন । রোমে স্টোইকবাদী দর্শন যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। ১৪০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ রোডস দ্বীপের প্যানেটিয়াস এই মতবাদ রোমে প্রথম প্রচার করেন।



বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে রোমানদের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে আইন প্রণয়ন। খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রোমানরা ফৌজদারি ও দেওয়ানি আইনগুলো সুষ্ঠুভাবে একসঙ্গে সাজাতে সক্ষম হন। ৫৪০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ১২টি ব্রোঞ্জ পাতে সর্বপ্রথম আইনগুলো খোদাই করে লিখিত হয় এবং জনগণকে দেখাবার জন্য প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়। রোমান আইনের দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান । রোমান আইনকে তিনটি শাখায় ভাগ করা হয়েছে। যেমন—

১. বেসামরিক আইনঃ এই আইন পালন করা রোমান নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। এই আইন লিখিত অলিখিত দুই রকম ছিল ।

২. জনগণের আইনঃ এ আইন সকল নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য ছিল । তাছাড়া ব্যক্তিগত অধিকার রক্ষার বিষয়টি এই আইনে ছিল। তবে এর মাধ্যমে দাসপ্রথাও স্বীকৃতি লাভ করে । সিসেরো এ আইনের প্রণেতা ।

৩. প্রাকৃতিক আইনঃ এ আইনে মূলত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার কথা বলা হয়েছে । আধুনিক বিশ্ব সম্পূর্ণভাবে রোমান আইনের ওপর নির্ভরশীল। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে সম্রাট জাস্টিনিয়ান প্রথম সমস্ত রোমান আইনের সংগ্রহ ও সংকলন প্রকাশ করেন ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url