যক্ষ্মা রোগ কি?-যক্ষ্মা রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা

যক্ষ্মা একটি মারাত্মক রোগ। এ রোগের জীবাণু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং বংশ বৃদ্ধি করে ফুসফুসের ক্ষতি সাধন করে। সময়মত চিকিৎসা না করলে ফুসফুসের এমন ক্ষতি হতে পারে যা কিনা মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বি.দ্রঃ এই পোষ্টের সকল তথ্য শুধুমাত্র তথ্য শেয়ারের জন্য। এই পোষ্টে উল্লিখিত ঔষধের নাম এবং সেবন বিধি শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জনের জন্য। কোন ধরণের চিকিৎসার জন্য নয়।

সূচিপত্রঃ- যক্ষ্মা রোগ কি?-যক্ষা রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা

যক্ষ্মা রোগের কারণ

মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস (Mycobacterium Tuberculosis) নামে এক ধরণের জীবানুর মাধ্যমে যক্ষ্মা হয়ে থাকে।

যক্ষা রোগ কিভাবে ছড়ায়

যক্ষ্মা রোগ সাধারণতঃ বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। যক্ষ্মা রোগের জীবাণু একজন আক্রান্ত রোগীর হাঁচি, কাশি বা কফ থেকে বাতাসে মিশে গিয়ে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে সুস্থ লোকের ফুসফুসে প্রবেশ করে। কোন সুস্থ ব্যক্তি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত লোকের সংস্পর্শে আসলে কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির কফ/ থুথুর মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়।

কোথায় কোথায় যক্ষ্মা রোগ হয়

  • ফুসফুস-শতকরা ৮৫ ভাগের উর্ধ্বে
  • ফুসফুসের আবরণী
  • গ্রন্থি
  • মস্তিস্ক
  • হাড়
  • অস্ত্র
  • শরীরের অন্যান্য স্থান

যক্ষ্মা রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ সমূহ

  • তিন সপ্তাহের অধিক সময় পর্যন্ত কাশি
  • প্রতিদিন সন্ধ্যায় বা রাতে জ্বর আসা
  • বুকে ব্যথা
  • ক্ষুধা কমে যাওয়া
  • ওজন কমে যাওয়া
  • অল্প শ্রমেই ক্লান্তি বোধ করা
  • মাঝে মাঝে কাশি বা কফের সাথে রক্ত আসে

যক্ষ্মা রোগে সতর্কতা অবলম্বন

যক্ষ্মা রোগীকে হাঁচি, কাশির সময় রুমাল/কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করতে হবে। যেখানে সেখানে কফ ও ঘুঘু ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে।

যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়

কোন ব্যক্তির তিন সপ্তাহের অধিক সময় কাশি বা উপরোলে-খিত এক বা একাধিক লক্ষণ থাকলে তাকে যক্ষ্মা রোগী বলে সন্দেহ করা যায়। কফ পরীক্ষার মাধ্যমে তার রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।প্রথমদিন সন্দেহজনক রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে/বক্ষ ব্যধি টিবি ক্লিনিক বা হাসপাতালে/এনজিও ক্লিনিকে এসে কফ পরীক্ষা করাতে হবে।
দ্বিতীয় দিন বাড়ী থেকে সারা রাতের কফ অথবা সকাল বেলার কফ পাত্রে সংগ্রহ করে চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে এবং কেন্দ্রে আসার পর আরো একবার কফ দিতে হবে। মোট তিনবার কফ পরীক্ষার রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় করা হয়। যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে যক্ষ্মা লক্ষণ সুস্পষ্ট থাকে অথচ কফ পরীক্ষায় কোন জীবাণু না পাওয়া যায় তবে সে ব্যক্তির রোগ নির্ণয়ের দায়িত্ব সংশি-ষ্ট চিকিৎসা কেন্দ্রের চিকিৎসকের।

যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ

  • রিফামপিসিন
  • আইসোনিয়াজিড
  • পাইরাজিনামাইড
  • ইথামবিউটাল
  • স্ট্রেপটোমাইসিন
  • থিয়াসিটাজোন

যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা

যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ
ক্যাটাগরী-১ঃ নতুন রোগী যাদের কফ পরীক্ষায় যক্ষ্মা রোগের জীবাণু পাওয়া যায় অথবা কফে জীবাণু পাওয়া যায় নাই কিন্তু ফুসফুসে যক্ষ্মা আছে এবং গুরুতর অসুস্থ নতুন রোগী (চিকিৎসকের পরামর্শানুযায়ী) অথবা মিলিয়ারী বা মস্তিকের যক্ষ্মা রোগী।
ক্যাটাগরী-২ঃ ভালো হয়ে যাওয়ার পর (স্বল্প মেয়াদী চিকিৎসায়) পুনরায় যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত (জীবাণুযুক্ত কফ) এবং নতুন যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে ৫ম মাসেও যদি কফে যন্ত্রা জীবাণু পাওয়া যায় (ফেইলুর)।
ক্যাটাগরী-৩ঃ যাদের কফ পরীক্ষায় যক্ষ্মা রোগের জীবাণু পাওয়া যায় নাই অথচ বুকের ছবিতে এ্যাকটিভ লিসন (যক্ষ্মা) আছে এবং ফুসফুস বর্হিভূত যক্ষ্মা (চিকিৎসকের পরামর্শানুযায়ী)।
ক্যাটাগরী-১
প্রাথমিক দুইমাস প্রতিদিন (ইনটেনসিভ ফেজ)
ওজন ওষুধের নাম
আইসোনিয়াজিড রিফামপিসিন পাইরাজিনামাইড ইথামবিউটাল
৩৩ কেজির কম ২০০ মিঃ গ্রাঃ ৩০০ মিঃ গ্রাঃ ১০০০ মিঃ গ্রাঃ ৮০০ মিঃ গ্রাঃ
৩৩-৫০ কেজি ৩০০ মিঃ গ্রাঃ ৪৫০ মিঃ গ্রাঃ ১৫০০ মিঃ গ্রাঃ ৮০০ মিঃ গ্রাঃ
৫০ কেজির বেশী ৩০০ মিঃ গ্রাঃ ৬০০ মিঃ গ্রাঃ ২০০০ মিঃ গ্রাঃ ১২০০ মিঃ গ্রাঃ
২ মাসের ইনটেনসিভ ফেজ শেষে রোগীর কফে যক্ষ্মার জীবাণু পাওয়া গেলে আরও অতিরিক্ত ১ মাস ইনটেনসিভ ফেজ চলবে। পরবর্তী মাসে যক্ষ্মা জীবাণু পাওয়া যাক বা না যাক চিকিৎিসা কনটিনিউয়িশন ফেজ এ চলে যাবে। ক্যাটাগরি-১ এর চিকিৎসায় প্রাথমিক ২/৩ মাস সম্পূর্ণ তত্ত্বাবধানে ওষুধ নিতে হবে।

তদারকিতে ওষুধ খাওয়ানো (ডটস)

জীবাণু যুক্ত যক্ষ্মা রোগীদের স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্মুখে প্রতিদিন (২/ ৩ মাস) ওষুধ সেবন করাই ডটস (Directly Observed Treatment Short Course)। এতে যক্ষ্মার চিকিৎসা সম্পন্নের হার অনেক বৃদ্ধি পায়। রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয় এবং ভবিষ্যতে পুনঃ আক্রান্ত হবার আশংকা হ্রাস পায়।
রিলাপ্স বা ফেইলুর রোগীদের প্রতিদিনই (৮ মাস) স্বাস্থ্যকর্মীর সম্মুখে ঔষধ সেবন করতে হবে। তাছাড়াও ডটস্ পদ্ধতিতে নিম্নোক্ত পাঁচটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
  • যক্ষ্মা রোগ নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক/সরকারি/বেসরকারি অঙ্গীকার।
  • তিন সপ্তাহের অধিক কাশি এমন সন্দেহজনক যক্ষ্মারোগীদের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে/বক্ষব্যধি ক্লিনিক/এনজিও ক্লিনিক এ উপস্থিত হয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগ হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে।
  • জীবাণুযুক্ত যক্ষ্মা রোগীদের সরাসরি তদারকিতে ঔষধ খাওয়ানো (Directly Observed Treatment Short Course)।
  • অব্যাহত ওষুধ ও অন্যান্য লজিস্টিক সরবরাহ।
  • মান সম্মত রেকর্ডিং ও রিপোর্টিং সিস্টেম চালু করা।
ক্যাটাগরী-১ঃ এর ক্ষেত্রে চিকিৎসার প্রথম দুই/তিন মাস সরাসরি তদারকিতে ওষুধ খাওয়ানোর জন্য নিম্নলিখিত যে কোন একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে।
  • রোগীকে প্রতিদিন চিকিৎসা কেন্দ্রে এসে ওষুধ খেতে হবে।
  • রোগীকে প্রতিদিন ইউনিয়ন সাব-সেন্টার/এফডবি-উসিতে এসে ওষুধ খেতে হবে।
  • স্বাস্থ্যকর্মীর বাড়িতে স্বাস্থ্যকর্মী কর্তৃক রোগীকে প্রতিদিন ওষুধ খাওয়ানো।
  • গুরুতর অসুস্থ রোগী অথবা যাদের নিয়মিত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে উপস্থিত হওয়া সম্ভবপর নয় তাদের হাসপাতালে ভর্তির মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
  • রোগীর কোন আত্মীয় বা দায়িত্বশীল কোন ব্যক্তি কর্তৃক প্রতিদিন রোগীকে ওষুধ খাওয়ানো।
পরবর্তীতে ৬ মাস রোগী নিজেই একবার ওষুধ সেবন করবেন। এক মাস অথবা ১৫ দিন অন্তর চিকিৎসা কেন্দ্র হতে ওষুধ সংগ্রহ করবেন। রোগী নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছেন কিনা সে সম্পর্কে খোঁজ নেবেন।
ক্যাটাগরি-২ঃ এর ক্ষেত্রে চিকিৎসার পুরো সময়েই রোগীকে সরাসরি তদারকিতে ওষুধ খেতে হবে।
ক্যাটাগরি-৩ঃ এর ক্ষেত্রে সরাসরি তদারকিতে ওষুধ খেতে হয়না। তবে স্বাস্থ্যকর্মীদের ১৫ দিন থেকে ১ মাস অন্তর রোগী পরিদর্শন করতে হবে।

চিকিৎসার ফলাফল নিরীক্ষণ

ক্যাটাগরি-১ঃ এর ক্ষেত্রে রোগীর অসুখের অবস্থা দেখা বা বোঝা এবং ওষুধের কার্যকারিতা অনুধাবনের জন্য চিকিৎসা শুরু করার ২ মাস পর, ৫ মাস পর ও ৮মাসের শুরুতে রোগীর কফ অবশ্যই পরীক্ষা করতে হবে। ২ মাস চিকিৎসা শেষে কফে জীবাণু পাওয়া গেলে ৩ মাস চিকিৎসা শেষে আরো একবার কফ পরীক্ষা করতে হবে।
ক্যাটাগরী-২ঃ এর ক্ষেত্রে চিকিৎসা শুরু করার ৩ মাস পর, ৫ মাস পর ও ৮ মাসের শুরুতে রোগীর কফ পরীক্ষা করতে হবে। এ কফ পরীক্ষার উপর রোগীর চিকিৎসা ও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠা নির্ভর করে।
ক্যাটাগরী-৩ঃ এর ক্ষেত্রে ফুসফুসের যক্ষ্মা রোগীদের ২ মাস চিকিৎসা করার পর একবার কফ পরীক্ষা করাতে হবে।

যক্ষা প্রতিরোধে করনীয়

যক্ষ্মা রোগীকে নিয়মিত ওষুধ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা
অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওষুধ খাওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রোগী সুস্থতা অনুভব করে। এ সুস্থতা অত্যন্ত সাময়িক ও আপেক্ষিক। কারণ এ সময়ে রোগীর শরীরে যক্ষ্মার জীবাণু বিদ্যমান থাকে। রোগ সম্পূর্ণ নিরাময়ের জন্য চিকিৎসক ওষুধ বন্ধ করার পরামর্শ না দেয়া পর্যন্ত চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।
তা না হলে রোগী পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়বে এবং রোগ জটিল আকার ধারণ করে জীবনের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ
  • সমাজের সকল স্তরের জনগণকে যক্ষ্মা রোগ সম্মন্ধে নিম্নলিখিত তথ্য জানাতে হবে এবং এ রোগ নিয়ন্ত্রণে তাদের সহযোগিতা কামনা করতে হবে।
  • বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থায় যক্ষ্মা রোগ ৮ মাসেই সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়।
  • রোগ নিরাময়ের জন্য প্রয়োজন নিয়মিত, ক্রমাগত ও সঠিক মাত্রায় ওষুধ খাওয়া। রোগীর জন্য দামী খাবারের কোন প্রয়োজন নেই।
  • সকল উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র/বক্ষব্যধি ক্লিনিক/এনজিও ক্লিনিকে বিনা মূল্যে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা করা হয়।
  • এ রোগের সংক্রমণ ক্ষমতা চিকিৎসা শুরু করার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আর থাকে না। তাই এ রোগের থেকে ভয় পাবার কোন কারণ নেই।
  • জানা-শোনা বা আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কারো যক্ষ্মা রোগ হলে সে যাতে নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করে সে জন্য উৎসাহ প্রদান বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
  • কোন ব্যক্তির তিন সপ্তাহের বেশী কাশি থাকলে তাকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কফ পরীক্ষার জন্য পাঠানো।

সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভের জন্য করনীয়

  • নিয়মিত, ক্রমাগত, সঠিক মাত্রায় ও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ওষুধ খাওয়া
  • ওষুধ খাওয়ার ফলে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া
  • চিকিৎসক সুস্থ ঘোষণা না করা পর্যন্ত চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া।
তথ্যসুত্রঃ (পরিবার কল্যাণ সহকারী এবং পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক) সহায়িকা

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url