বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প রচনা-বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প প্রবন্ধ

পর্যটনের অপর নাম হলো বিনোদন। অবসর যাপন অথবা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থান কিংবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করাকে পর্যটন বলে। কোথাও ভ্রমন করার সময় পরিবহন ব্যাবস্থার, থাকার জন্য আবাসন, খাবার জন্য রেস্তোরা, কেনাকাটার জন্য দোকানের প্রয়োজন হয়। আর এ সকল জিনিসের সমন্বয়ে যে শিল্প গড়ে ওঠে তাকে পর্যটন শিল্প বলে।
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প রচনা-বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প প্রবন্ধ
সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষের মাঝে পর্যটনের ধারণা চলে আসছে। ব্যবসার জন্য কিংবা বিনোদনের জন্য বা দেশ বিদেশ দেখার জন্য মানুষ মাইলের পর মাইল ছুটে চলে, এমনকি পাড়ি দিয়েছেন অতল সমুদ্র। তারই ধারাবাহিকতায় কলম্বাস নামের একজন নাবিক আমেরিকা আবিষ্কার করেন। সৌন্দর্য ও শিল্পের জন্য আমাদের বাংলা প্রাচীন কাল থেকেই বিশ্বে পরিচিত ছিলো। তাই বাংলার রুপ ও সৌন্দর্যের টানে মধ্যযুগে ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাং এর মত বিখ্যাত পরিব্রাজক গণ এ দেশে পর্যটনে এসেছিলেন।

সূচিপত্রঃ- বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প রচনা-বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প প্রবন্ধ

ভূমিকা

পৃথিবীব্যাপী জ্ঞানী ও প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ ছোটে লোক থেকে লোকান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে। প্রতিনিয়ত মানুষ জানতে চায়, বুঝতে চায়, জয় করতে চায় অজানাকে। তাই তো হিমালয় ও চাঁদের মতো দুর্গম স্থানকেও মানুষ জয় করেছে। পুরাতাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করে উপহার দিয়েছে নতুন পৃথিবী। জ্ঞানের জন্য, জানার জন্য সমস্ত বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করেছে মানুষ। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মতো অপার বৈচিত্যময় বাংলাদেশেরও আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য স্থান, অসংখ্য স্থাপত্য। তাই দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বলেছেন, 'সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি'। বাংলাদেশের অনেক জায়গায় রয়েছে ঐতিহ্যময় পর্যটন স্থান। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের প্রকৃতি এবং বাঙালি জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে পরিচিত করার শ্রৈষ্ঠ উপায় হচ্ছে পর্যটন।

পর্যটনশিল্পের গুরুত্ব

অন্যান্য শিল্পের মতো পর্যটনও একটি অন্যতম শিল্প। কথায় আছে, 'গ্রন্থগত বিদ্যা আর পর হস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন'। আসলে জীবনভর ভারী ভারী বইপুস্তক পড়ে যতটুকু শেখা সম্ভব তার চেয়ে বেশি সম্ভব যদি চোখে দেখা যায়। কারণ মানুষ তার জ্ঞানের শতকরা ৭০ ভাগ চোখ নামক ইন্দ্রিয় দিয়ে গ্রহণ করে। যে নাকি আগ্রার তাজমহল কিংবা মিশরের পিরামিড বা নায়াগ্রার জলপ্রপাত চোখে দেখেনি, সে বই পড়ে তার মর্মার্থ বুঝতে অপারগ। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ জ্ঞানপিপাসু। মানুষ ও তার কীর্তি সম্পর্কে এবং প্রকৃতি ও তার মহিমার অজানা রহস্য পর্যটনের মাধ্যমেই জানা যায়।
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প রচনা-বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প প্রবন্ধ
এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের আচার- আচরণ, স্থান, সৌন্দর্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, রীতি-নীতি, আকৃতি-প্রকৃতি, প্রাচীনত্বের নিদর্শন, পশুপাখি প্রভৃতি সম্পর্কে পর্যটনশিল্পের মাধ্যমেই জানা যায়। এই পর্যটনশিল্পকে পুঁজি করেই শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তুলেছে বিশ্বের অনেক দেশ। মালয়েশিয়া, দুবাই, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশসমূহ তার উজ্জ্বল উদাহরণ। বাংলাদেশেও রয়েছে পর্যটনশিল্পের অমিত সম্ভাবনা। বিদেশি পর্যটকদের এ দেশের প্রতি আকৃষ্ট করে একদিকে যেমন দেশ আর্থিকভাবে লাভবান হবে, অন্যদিকে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে এই শিল্পে নিয়োগ করলে বেকারত্ন সমস্যারও সমাধান হবে। সুতরাং বলা যায়, পর্যটনশিল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

বাংলাদেশের পর্যটন স্থান

বাংলাদেশকে কেউ কেউ বলেছেন চিরসুন্দরী, কেউ বলেছেন চিরসবুজ, কেউ বলেছেন সকল দেশের রানী। অর্থাৎ আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে দেশ-বিদেশের বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা বিভিন্ন রকম সুন্দরের ব্যাখ্যা করেছেন। ষড়ঋতুর বৈচিত্রা ছাড়াও সবুজ-শ্যামল স্নিগ্ধ প্রকৃতি মানুষকে সহজেই আকর্ষণ করে। বাংলাদেশের প্রকৃতি হচ্ছে মাতৃত্বের মতো শান্ত স্নেহদায়ী। বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মনোমুগ্ধকর পর্যটন স্থান। পাহাড়পুর, রাঙামাটি, সাগরদিঘি, ময়নামতি, কুয়াকাটা, পাথরঘাটা, সোনারগাঁ, বান্দরবান, সুন্দরবনসহ আরও অসংখ্য পর্যটন স্থান ইতিহাস ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত রয়েছে বাংলাদেশের কক্সবাজারে। বাংলাদেশের একদিকে সুউচ্চ পাহাড় অন্যদিকে বিশাল জলরাশি। যা সহজেই পর্যটকদের মুগ্ধ করে। বাংলাদেশে খোদ রাজধানীতে রয়েছে অসংখ্য ইতিহাস-আশ্রিত ঐতিহ্যময় স্থান এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ স্থান।

বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের বাস্তবতা

পর্যটনশিল্পে বাংলাদেশের উন্নতির সম্ভাবনা অনুধাবন করে- এর উন্নয়নে মনোযোগী হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্থানগুলোকে লাভজনক করে গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট ইত্যাদি অঞ্চলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড় বেশ আশাব্যঞ্জক। আন্তর্জাতিক পর্যটন সংস্থাগুলোর সাথে দেশীয় সংস্থা ও সংগঠনগুলোর সাংস্কৃতিক বিনিময় হচ্ছে নিয়মিত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাজনিত সমস্যার কারণে পর্যটন স্থানগুলোতে আগের মতো পর্যটকরা আসছেন না। তাছাড়া বিদেশি পর্যটকদের জন্য উন্নত সুযোগ-সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করায় দেশীয় পর্যটকদের জন্য ভ্রমণের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন দেশীয় পর্যটকগণ।

পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা

বাংলাদেশে ইতঃপূর্বে পর্যটকদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সুযোগ-সুবিধা ছিল না। তার পরও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার পর্যটক মুগ্ধ হয়ে আসত শুধু প্রকৃতি অবলোকনের জন্য। সম্প্রতি সরকার পর্যটকদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যটন স্থানে হোটেল ও মোটেল করেছে। বিভিন্ন বেসরকারি হোটেলের চেয়ে এসব সরকারি হোটেলে অত্যন্ত সুলভমূল্যে সিট বুকিংয়ের সুবিধা দিয়েছে। তাছাড়া যাতায়াতের জন্য বিভিন্ন রকমের যানবাহনের ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। পর্যটকদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান ও সামগ্রিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করাই এর প্রধান কাজ।

পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব

বাংলাদেশ পর্যটনশিল্পে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য দুর্লভ এবং সুন্দর স্থান। এ স্থানগুলোকে সংরক্ষণের জন্য পর্যটন করপোরেশনের বিশেষ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম দ্বারা বাংলাদেশের পর্যটন স্থানগুলোকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে হবে। এসব পর্যটন স্থানে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করাসহ যাতায়াতব্যবস্থা সহজ ও স্বল্পব্যয়ের আওতায় আনতে হবে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোর পরিবেশ যাতে সুন্দর থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে। পর্যটনের সাথে সম্পর্কিত সংস্থা ও সংগঠনগুলোকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। তাহলেই বিশ্বজুড়ে পর্যটনশিল্পে বাংলাদেশের স্থান সুউচ্চ হবে। তাই বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে পর্যটন করপোরেশনের দায়িত্ব ও কর্তব্য অপরিসীম।

উপসংহার

প্রখ্যাত শিল্পী ও সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় আধুনিক পর্যটন শিল্পনগরী ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন- 'অর্ধেক সুন্দরী তুমি, অর্ধেক কল্পনা।' তাঁর এ মন্তব্য সম্পর্কে আমরাও বলতে পারি, প্যারিসের অর্ধেক সৌন্দর্যকে কল্পনা করে নিতে হয় কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের সবুজ, শ্যামল সৌন্দর্যকে কল্পনা করে নিতে হয় না। তা একই সাথে দৃশ্যমান ও অনুভব্য। বাংলাদেশের পর্যটন স্থানের সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। বাংলাদেশে পর্যটন করপোরেশন, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সর্বোপরি সকলেই একটু সচেতন হলে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আসনে আসীন হবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url