বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রচনা-বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ সমাহার হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশে রয়েছে নজর কাড়া হাওর-বাওর, বিল-ঝিল, নদী, সাগর, পাহাড়-উপত্যাকা। সিলেটের তামাবিল, কমালার বাগাম কার না হৃদয় কাড়ে! রাঙামাটির পার্বত্য শ্যামলিমা, আকাশ হেলান দেয়া বন-পাহাড় ভ্রমন পীপাষু মানুষের হৃদয়কে আকৃষ্ট করে।
সূচিপত্রঃ- বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রচনা-বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা
- ভূমিকা
- অপরূপ বাংলাদেশ
- গ্রামবাংলার রূপশোভা
- বহমান নদনদী
- ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ
- বনভূমির সৌন্দর্য
- অপরূপ সমুদ্রগাঁথা
- পাহাড়-টিলার সৌন্দর্য
- বিভিন্ন প্রহরের সৌন্দর্য
- হতাশার কথা
- উপসংহার
ভূমিকা
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। প্রতিটি দেশের স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্য ও রূপ ফুটে ওঠে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাধ্যমে। তাই বিশ্বপ্রকৃতির অনন্ত বৈচিত্র্যের মাঝে যারা নিজেকে খুঁজে পেতে চায়, তাদের অনেকের কাছে বাংলাদেশ যেন সৌন্দর্যের এক তীর্থস্থান। এ দেশের নির্মল আকাশ, নদী-কান্তার, পুষ্প-পল্লব, ছায়াঢাকা গ্রাম, মায়াভরা পাহাড়, সুবিশাল সমুদ্র- সব মিলিয়ে এক অপূর্ব আবেদন সৃষ্টি করেছে। কবি কণ্ঠে তাই বাংলাদেশের প্রশস্তি “নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মম, চির মনোরম, চির মধুর।”
অপরূপ বাংলাদেশ
বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। বাংলাদেশের যেদিকেই দৃষ্টিপাত করি না কেন, প্রতিটি স্থানেই চোখজুড়ানো সৌন্দর্য আবিষ্কার সম্ভব। শস্য-শ্যামল গ্রামগুলো অপরূপ মাতৃময়ী ভগিতে সদা হাস্যোজ্জ্বল। বাংলাদেশের নদ-নদী ভাবুকের হৃদয়ে অফুরন্ত ভাব জাগিয়ে বয়ে চলেছে। সবুজ পাহাড় আর টিলার সৌন্দর্য রূপপিয়াসি মানুষকে হাতছানি দিয়ে এসেছে চিরকাল। সমুদ্র দিনরাত এ দেশের পা ধুইয়ে দিচ্ছে। আকাশ নীলের ঘনঘটায় এদেশের দিগন্ত প্লাবিত। মাঠের শ্যামলিমা সবুজ শাড়ি হয়ে এ দেশকে জড়িয়ে রেখেছে। সবুজ বনরাজি বাংলাদেশের শিরে পরিয়েছে রানির মুকুট। নানা ঋতুতে বাংলাদেশ সেজে ওঠে ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র্য নিয়ে। দিন ও রাতের একেক সময়ে একেক সৌন্দর্য ধরা পড়ে সৌন্দর্যপ্রেমীদের চোখে। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য যেন একাই ধারণ করে আছে এ দেশ। বাংলার রূপমুগ্ধ কবির উচ্চারণ-
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।”
গ্রামবাংলার রূপশোভা
বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম যেন প্রকৃতির এক অপূর্ব রঙ্গশালা। যেদিকে চোখ যায়- অবারিত সবুজ মাঠ, ফুলে-ফলে-পাতায় সাজানো বৃক্ষরাজি, তৃণ-গুল্মশোভিত বন-বনানী, শ্যামল শস্যক্ষেত্রের এই অনুপম বৃপসুধা পান করে সবার হৃদয়ে এক অভিনব আনন্দের শিহরণ জাগে। কোথাও প্রকৃতির সবুজের ঘোমটা ভেদ করে পাকা শস্যের সোনালি মুখখানা নজরে আসে। আবার কোথাও বিশালদেহ বটবৃক্ষ প্রান্তরের এক স্থান উর্ধ্ববাহু হয়ে মৌন তাপসের মতো দাঁড়িয়ে সুশীতল ছায়া দিয়ে পথিকের ক্লান্তি দূর করছে। কোথাও তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে আকাশ থেকে নীলিমা ছিনিয়ে আনতে চাচ্ছে। আবার কোথাও কাকচক্ষু দিঘির জলে লাল শাপলা ও পদ্ম ফুটে অপরূপ সৌন্দর্য বিস্তার করছে। বাংলাদেশের গ্রামের এই সৌন্দর্য সবার মন ভরিয়ে দেয়। গ্রামের মাটির পরশ আর শ্যামলিমায় অভিভূত কবির অনুভূতি-
“আমার দেশের মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন
শ্যামল কোমল পরশ ছাড়া যে নেই কিছু প্রয়োজন।”
বহমান নদনদী
বাংলাদেশের বুকজুড়ে বয়ে চলেছে ছোটো-বড়ো অসংখ্য নদ-নদী। নদীর আধিক্যের কারণে এদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। এ নদ-নদীগুলো বাংলার অতুলনীয় সৌন্দর্যের অন্যতম আধার। প্রতিটি নদীই স্বতন্ত্র সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। কোনোটি শান্ত, কোনোটি বা খরস্রোতা, কোনোটির জল স্ফটিক-স্বচ্ছ, কোনোটির কাজল কালো, কোনোটি ঘোলা, কোনোটি আবার নীলচে। নদীর অবিরাম স্রোতধারা, নদীর বুকে বয়ে চলা জেলেদের ডিঙি সৌঝা, ভেসে যাওয়া কচুরিপানা, নদীর পানিতে সূর্যরশ্মির আলোকচ্ছটা, নদীতীরের কাশবন এসবের মিলিত সৌন্দর্য বাংলাদেশের নদীগুলোকে করেছে মোহময়। নদীর সাথে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ কতখানি গভীরভাবে জড়িয়ে আছে, তা গীতিকারের কলমে এভাবেই প্রকাশ পেয়েছে-
“এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদীতটে
আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়
এ আমার দেশ, এ আমার প্রেম
কত আনন্দ-বেদনায় মিলন-বিরহ-সংকটে।”
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ
বাংলাদেশের রূপবৈচিত্র্যে অসাধারণ বিশিষ্টতা যোগ করেছে ষড়ঋতু। সারা বছর ছয়টি ঋতুর ধারাবাহিক আসা-যাওয়ায় বাংলার উঠানে রূপের মেলা বসে। গ্রীষ্মের রুক্ষ, ধূসর প্রকৃতি বর্ষার আগমনে শ্যামলিমা ও স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে। বর্ষার পর নীল আকাশে সাদা মেঘ ভাসিয়ে আর কাশফুলের পরশ নিয়ে আসে শরৎ। শীতের আগমনী আর নতুন ফসলের বার্তা বয়ে আনে হেমন্ত। শীতে প্রকৃতি হয়ে পড়ে জীর্ণ আর শীতের রিস্ততার পর পূর্ণতা নিয়ে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। এসময় পুষ্প-পল্লবের প্রাণপ্রাচুর্যে মুখরিত হয় চারদিক। বাংলাদেশের মতো এত বেশি ঋতুভিত্তিক রূপবৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোনো দেশে দেখা যায় না। ঋতুর বৈচিত্র্যে বাংলাদেশ সারা বছরই হয়ে থাকে রূপসী বাংলা।
বনভূমির সৌন্দর্য
অপূর্ব সৌন্দর্যে সজ্জিত এ দেশের রয়েছে গাঙ্গেয় অববাহিকায় জেগে ওঠা উর্বর পলিমাটির দ্বীপ। এ সমৃদ্ধ মাটিতে জন্ম নিয়ে যুগে যুগে পরিণতি লাভ করেছে প্রচুর বনাঞ্চল। বিশ্বজুড়ে পরিচিতি রয়েছে বাংলাদেশে অবস্থিত ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের নাম, যেখানকার বিশাল বনানীতে সৃষ্টি হয়েছে স্বতন্ত্র এক জীবনধারা। সুন্দরবন ছাড়াও স্বতন্ত্র রূপমাধুর্যে সমুজ্জ্বল ভাওয়াল ও মধুপুরের বনাঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, বান্দরবান ইত্যাদি অঞ্চলের বনাঞ্চল। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের চিরকালীন আকর্ষণ এই সবুজ বন-বনানী।
অপরূপ সমুদ্রগাঁথা
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আরেক আকর্ষণের নাম সমুদ্র। বাংলাদেশের রয়েছে নয়নাভিরাম এবং পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, যা এ দেশের দক্ষিণ সীমাজুড়ে বিস্তৃত। কক্সবাজার, কুয়াকাটা, পতেঙ্গা ইত্যাদি হলো দেশের উল্লেখযোগ্য সমুদ্রসৈকত। অফুরন্ত জলরাশি, বালুকাময় দিকচিহ্নহীন সৈকত, সৈকতজুড়ে প্রবালের প্রাচীর, পার ধরে দাঁড়িয়ে থাকা নারিকেল, কেয়াগাছের সারি, সুনসান নীরব রাতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের গর্জন এসব প্রত্যক্ষ করার জন্য সৌন্দর্যপিপাসুরা বারবার ফিরে আসে হৃদয়হরা সমুদ্রের কোলে।
পাহাড়-টিলার সৌন্দর্য
বাংলাদেশের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আরেক অন্যতম এবং বৈচিত্র্যময় দিক হলো দেশের পাহাড় ও টিলা। ছোটো-বড়ো নানা আকারের পাহাড় ও টিলা রয়েছে সিলেট, নেত্রকোনাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের পুরো অংশজুড়ে। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া আঁকাবাঁকা রাস্তা, পাহাড়ের গায়ে অপরূপ ঝরনা আর জলপ্রপাত, সবুজ গাছপালায় পরিপূর্ণ গহিন পাহাড়ি বনাঞ্চল, পাহাড়ি নদীর ক্ষুরধার স্রোত- সব মিলিয়ে বাংলার পাহাড়ি সৌন্দর্য অসাধারণ ভালোলাগার শিহরণ জাগায়।
বিভিন্ন প্রহরের সৌন্দর্য
দিন-রাতের বিভিন্ন প্রহরে বাংলাদেশের রূপময়তার বৈচিত্র্য সংবেদনশীল মানবমনকে ছুঁয়ে যায়। ভোরবেলার শান্ত প্রকৃতির স্নিগ্ধ রূপ মনকে প্রশান্ত করে তোলে। আঁধারঘেরা সন্ধ্যার মৌনতায় মন হয়ে ওঠে উদাস। ভরা পূর্ণিমার রাতে যখন মাঠঘাট দিগন্তপ্লাবী জোছনায় থই থই করে, তখন তার রূপের আকর্ষণে মন হয়ে ওঠে এক মুক্ত বিহঙ্গ। আবার প্রখর রৌদ্র-নীল আকাশ কিংবা ঝুম বৃষ্টির আগমুহূর্তের মেঘে ঢাকা কালো আকাশও অসাধারণ সৌন্দর্য ও ভালোলাগার আবহ সৃষ্টি করে।
হতাশার কথা
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সারাবিশ্বে প্রশংসিত হলেও সময়ের সাথে সাথে এ সৌন্দর্যে ভাটা পড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে নানা স্থানের প্রকৃতিকে ধ্বংস করে গড়ে উঠছে যান্ত্রিক সভ্যতা। তৈরি হচ্ছে বড়ো বড়ো কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান। জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ গিয়ে পড়ছে প্রকৃতির ওপর। জীবনধারণের তাগিদে মানুষ ধ্বংস করছে প্রকৃতি। চোখজুড়ানো সবুজের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। পাহাড় উজাড় করে স্থাপিত হচ্ছে আবাসস্থল। নদী, সমুদ্রসহ অন্য জলাশয়গুলো দূষিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখন হুমকির সম্মুখীন। বাংলার এই সৌন্দর্য যেন অটুট থাকে তার জন্য প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে এবং প্রকৃতির প্রতি নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে আমাদের সকলকেই সচেতন হতে হবে।
উপসংহার
পৃথিবীতে সৌন্দর্যের যত ধারণা আছে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে তার সবই যেন পূর্ণরূপে বিকশিত। আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সৌন্দর্যপিয়াসি মানুষকে করেছে ঘরছাড়া। বাংলাদেশকে প্রকৃতির সুরম্য লীলানিকেতন বললে ভুল হবে না। প্রাকৃতিক সুষমাই বাংলাদেশকে সকল দেশের রানিতে পরিণত করেছে। কবির ভাষায়-
“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।”
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url