আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রচনা
প্রত্যেক জাতির একটি নির্দিষ্ট ভাষা আছে, যার মাধ্যমে ঐ জাতি নিজেদের ভাব প্রকাশ
করে থাকে। ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে একটি জাতি সমন্বিতভাবে যে ভাষা ব্যবহার
করে, তাকে মাতৃভাষা বলে। অন্যভাবে বললে- শিশু জন্মের পর মায়ের মুখ থেকে যে ভাষায়
কথা বলতে শেখে ও মনের ভাব প্রকাশ করে, তাকেই মাতৃভাষা বলে।
সূচিপত্রঃ- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রচনা
ভূমিকা
মাতৃভাষার মাধ্যমেই একটি জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটে থাকে।
তাই মাতৃভাষা যেকোনো জাতির জন্য একটি অপরিহার্য প্রকাশ মাধ্যম। এ মাতৃভাষাকে
রক্ষার জন্য রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতি সৃষ্টি করেছে অনন্য। ইতিহাস। বাংলার দামাল
ছেলেরা তাজা রক্তের বিনিময়ে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছিনিয়ে আনে মাতৃভাষার
অধিকার। প্রতিষ্ঠা পায় বাংলা ভাষা। সে মহান আত্মত্যাগের ফলে মহান একুশ এখন
'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'। বায়ান্নর অর্জন আরও তাৎপর্য লাভ করেছে, আরও
মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে জাতিসংঘের এ স্বীকৃতির মাধ্যমে।
মাতৃভাষা দিবসের পটভূমি
১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে থেকেই বাংলা ভাষাকে লড়াইয়ে নামতে হয় উর্দুর প্রতিপক্ষ
হিসেবে। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন
আহমদই প্রথম বাংলাকে উর্দুর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেন। তিনি বলেন, 'ভারতে
যেমন হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হতে যাচ্ছে, পাকিস্তানেও তেমনিই উর্দু রাষ্ট্রভাষা হওয়া
উচিত।' সঙ্গে সঙ্গে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এসেছিল এবং বাংলার জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ
শহীদুল্লাহ্ 'দৈনিক আজাদে' এক প্রবন্ধে বলেন, 'অধিকাংশ জনসংখ্যার ভাষা হিসেবে
বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত'।
বস্তুত ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেখা যায়, পাকিস্তানের কোনো
অঞ্চলের মানুষেরই মাতৃভাষা উর্দু নয়। পাকিস্তান জন্মের মাত্র তিন মাসের মধ্যেই
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে করাচি শিক্ষা সম্মেলনে কেন্দ্রীয়
শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার একটি
প্রস্তাব পাশ করে নেওয়া হয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। সে বছর ৬ই
ডিসেম্বর ১৯৪৭ ঢাকার রাজপথে তৎকালীন পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ এর বিরুদ্ধে তীব্র
বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ থেকে ১৫ই মার্চ পর্যন্ত লাগাতার
সংগ্রামের ফসল হিসেবে পূর্ব বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন
ছাত্রদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদার
প্রশ্নটি মেনে নিয়েছিলেন।
কিন্তু পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ২১শে মার্চ রেসকোর্সের
জনসভায় এবং ২৪-এ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে উর্দুকেই
একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দেন। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-জনতার মধ্যে প্রতিবাদের ঝড়
ওঠে এবং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে
খাজা নাজিমুদ্দিন মুসলিম লীগের এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, 'একমাত্র উর্দুই
হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা'। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফুসে উঠেছিল বাঙালি। পূর্ব
বাংলায় শুরু হয়েছিল মহান ভাষা আন্দোলন।
সে বছর একুশে ফেব্রুয়ারি বুকের রক্ত দিয়ে ছাত্রসমাজ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা ও
স্বীকৃতিকে আদায় করে নিয়েছিল। আজ বিস্মিত হতে হয় সেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে
তৎকালীন বাঙালি মানসের চেতনার পরিপক্কতা দেখে। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো
যে চেতনায় প্রস্তাবনা পাশ করেছে, ১৯৫২ সালে তৎকালীন ভাষাসংগ্রামীরা সেই
প্রেরণাকেই নাগরিকদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। আর এটাই হলো- সকল মাতৃভাষার মর্যাদা ও
স্বীকৃতি।
অমর একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও তাৎপর্য
বাঙালির ইতিহাসে অসংখ্য উজ্জ্বল মাইলফলক আছে, যা অর্জনের সমৃদ্ধতায় উজ্জ্বল। এমনই
একটি মাইলফলক নিঃসন্দেহে ১৭ই নভেম্বর ১৯৯৯। ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারির স্বীকৃতি বাঙালির জন্য এক উজ্জ্বল মাইফলক।
এই অমর একুশের মধ্যে নিহিত বাঙালির ভাষাভিত্তিক স্বাতন্ত্র্যের বীজ। সুতরাং অমর
একুশকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালির
প্রতীকী বিজয় নির্দেশিত হয়েছে। ভাষাশহিদদের আত্মদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
মিলেছে। ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অমর একুশে এখন বিশ্বে তাৎপর্যমণ্ডিত
প্রতীক- যা বাঙালির গর্ব আর অহংকারের দ্যোতক। ২১শে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক
স্বীকৃতি লাভ বাঙালি জাতির জন্য এক বিরাট গৌরব। সারা- বিশ্বের মানুষ বাংলাদেশ
নামে একটি দেশের কথা, বাঙালি জাতি ও ভাষার কথা জানতে পারছে। ভাষার আগ্রাসনের
বিরুদ্ধে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' এক বিরাট ভূমিকা পালন করতে থাকবে। এ দিবসের
তাৎপর্য উল্লেখ করে বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদ বলেছেন-
“আমি মুগ্ধ, আমি প্রীত, আমাকে
স্বীকৃতি দিয়েছে, আমার প্রাণের
কথা আমার ভাষায় জানতে পারব
বলে আমার হৃদয় স্পন্দন বেড়েছে,
সত্যি গর্বিত আমি।”
মাতৃভাষা দিবসের প্রায়োগিকতা
মাতৃভাষা দিবসের প্রায়োগিকতা তিনটি। যেমন-১. বাঙালি আত্মবিকাশে বিশ্বময় সহায়তাপ্রাপ্ত হবে।
২. বাঙালির জাতিসত্তা ফুটে উঠবে।
৩. জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে ফুটে উঠবে বাঙালির অবিস্মরণীয় অবদান।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম আনন্দ উৎসব
মহান ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়ায় সরকারের
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৯৯৯ সালের ৭ই ডিসেম্বর উৎসবের ঘোষণা দেয়। ২০০০ সালের ২১শে
ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে এ উৎসবটি পালিত হয়। দিনভর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে
আয়োজিত হয় আনন্দ শোভাযাত্রা- একুশ আমাদের অহংকার, একুশ পৃথিবীর অলংকার ইত্যাদি
স্লোগানে দিগ্বিদিক মুখরিত হয়। আলোচনা, আবৃত্তি, নাচ-গান ইত্যাদি সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয় এ অনুষ্ঠানে।
বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন
২১শে ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে মর্যাদা লাভ করায় বাঙালি
ভাষাশহিদদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সারাদেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষ
ছুটে যায় শহিদ মিনারে। আজ আমরা গর্ব করে বলতে পারি, বাঙালিই একমাত্র জাতি যারা
মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিতে দ্বিধা
করেনি। বিশ্ববাসী স্বীকৃতি দিয়েছে আমাদের মাতৃভাষাকে। জাতিসংঘের মহাসচিব এ দিবসটি
উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বার্তা প্রেরণ করেন। এ দিবসটি পালনের মাধ্যমে
বিশ্ববাসী তাদের জাতিসত্তার প্রধান বিবেচ্য বিষয় মাতৃভাষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে
সক্ষম হবে। প্রতাপশালী অন্য ভাষার করাল গ্রাস থেকে প্রতিটি জাতি নিজ নিজ
মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে। 'একুশে ফেব্রুয়ারি' তাই মাতৃভাষা
রক্ষার প্রতীক হয়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মর্যাদা অপরিসীম।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সংস্কৃতির সেতুবন্ধ
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটিকে বিশ্বের প্রায় ১৮৮টি দেশ প্রতিবছর পালন করে। ফলে
তারা বাংলাদেশের ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য সভ্যতাকে জানতে আগ্রহী হচ্ছে। বাংলার
বিখ্যাত কবি- সাহিত্যিকদের সৃষ্টি সম্পর্কে জানছে। বিশ্বের দরবারে বাংলা সাহিত্য,
সংস্কৃতি একটি বিশিষ্ট স্থান লাভ করছে। সারাবিশ্ব জানতে পারছে, বাঙালিই একমাত্র
জাতি, যাঁরা ভাষার জন্য লড়াই করে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। মে দিবসে
বিশ্ববাসী যেমন শিকাগোর শ্রমিক আন্দোলনকে স্মরণ করে, তেমনিভাবে এ দিনে বিশ্ব
বাংলার ভাষাশহিদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। ফলে আমাদের মাতৃভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি
ও সভ্যতার সঙ্গে বিশ্ববাসীর সেতুবন্ধ তৈরি হচ্ছে।
উপসংহার
বিশ শতকের শেষ প্রান্তে এসে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান
ইউনেস্কো মাতৃভাষাগুলোর অধিকার এবং একে মর্যাদাপূর্ণভাবে টিকিয়ে রাখতে যে
অনন্যসাধারণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা সমগ্র বিশ্বের ভাষাপ্রবাহে অসামান্য অবদান
রাখবে। একই সঙ্গে এই দিন বিশ্বের বৃহৎ ভাষাগুলোর পাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিপীড়িত,
অবহেলিত ভাষাগুলোও সংঘবদ্ধভাবে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাবে। আজ তাই বাঙালি
জাতির, তাঁর মাতৃভাষা এবং বিশ্বের অন্যান্য ভাষার প্রতি এ জাতির দায়িত্ব শতগুণে
বেড়ে গেল।
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url