মাদকাসক্তির কারণ ও প্রতিকার-মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার রচনা

সারা পৃথিবীতে তরুন প্রজন্ম ধংসের অন্যতম প্রধান কারণ হলো মাদকাসক্তি। মাদকের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে ১৯৯১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত একটি দশককে মাদক বিরোধী দশক হিসাবে ঘোষনা করে জাতিসংঘ। মাদক বিরোধী দিবস পালন করা হয় ২৬ জুনকে। মাদক শরীরের জন্য ক্ষতিকর জানার পরেও মানুষ কেন মাদক গ্রহন করে? মাদকাসক্তির কারণ কী? একবার ছেড়ে দেওয়ার পরও কেন মানুষ আবার সেই মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে? আপনার প্রিয়জন কেউ মাদকাসক্ত হলে কীভাবে তাকে মাদক মুক্তি করবেন?

সূচিপত্রঃ- মাদকাসক্তির কারণ ও প্রতিকার-মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার রচনা

  • ভূমিকা
  • মাদকের উৎস
  • মাদকাসক্তির কারণ
  • মাদকাসক্তির পরিণাম
  • বাংলাদেশে মাদকাসক্তির প্রভাব
  • মাদকাসক্তি প্রতিরোধ
  • উপসংহার

ভূমিকা

বিশ্বব্যাপী মানবসভ্যতার জন্য এক নিকষ কালো অধ্যায় মাদকাসক্তি। মাদক এক সর্বনাশা মরণনেশা। বিশ্বের প্রায় ৫০ থেকে ৬০ কোটিরও বেশি মানুষ এ মরণনেশায় আসক্ত। এর মধ্যে এশিয়ার সার্কভুক্ত ৭টি দেশে এর সংখ্যা এক কোটির কিছু বেশি। বিশেষ করে তরুণদের মাঝে মাদকের ভয়াবহ প্রভাব অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বাংলাদেশেও মোট জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ মাদকের নীল নেশায় আক্রান্ত। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবার, সমাজ, দেশ এককথায় সমগ্র জাতি। দুর্বার তারুণ্য হারিয়ে ফেলছে অফুরান প্রাণশক্তি, অজেয় সাহস আর বিদ্রোহী মনোবল। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও প্রগতি হচ্ছে বিপন্ন।

মাদকের উৎস

আন্তর্জাতিক বেশ কিছু চোরাচালানি সিন্ডিকেট আকাশপথে কিংবা সীমান্তপথে মাদক পাচারের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। বাংলাদেশেও এ ধরনের সিন্ডিকেট সক্রিয়। কিছুকাল আগেও থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম নিয়ে গড়ে উঠেছিল 'গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল' বা 'স্বর্ণ ত্রিভুজ' নামে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের স্বর্গভূমি। ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে গোল্ডেন ট্রায়াজাল ভেঙে যায়। পরবর্তীকালে ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে নিয়ে গড়ে তোলা হয় মাদক পাচারের নতুন স্বর্গ 'গোল্ডেন ক্রিসেন্ট।' পৃথিবীব্যাপী মাদকদ্রব্যের অবাধ বিস্তৃতির পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক এসব মাফিয়া চক্র।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করছে এদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। সন্ত্রাসবাদের মদদপুষ্ট এ মাদক কারবারিরা যেসব মাদকদ্রব্য চোরাচালান করে থাকে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হেরোইন, ইয়াবা, আফিম, কোকেন, মারিজুয়ানা, ব্রাউন সুগার, হাসিস, স্মাক, হোপ ইত্যাদি। নেশার ইতিহাস সুপ্রাচীন হলেও তা ছিল মদ, গাঁজা, আফিম, চরস, ভাং ইত্যাদির মধ্যে সীমিত। ফরাসি বিপ্লবের সময় পরাজিত সৈনিকদের অনেকেই হতাশা থেকে মুক্তি পেতে মাদকে আসক্ত হন। কিছু কিছু মাদক ব্যথা নিরাময়ে এবং চেতনানাশক হিসেবে ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং এর পরে ব্যথা উপশম ছাড়াও নেশার উপকরণ হিসেবে মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে।

ব্রাজিল, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, ইকুয়েডরসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে মাদক তৈরি ও চোরাচালানের বিশাল চক্র গড়ে ওঠে। সেই সাথে তা পাচার হতে থাকে পৃথিবীর অন্য দেশগুলোয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে, অতীতে উন্নত দেশগুলোর শতকরা ৮০ ভাগ লোকই মাদকে কমবেশি আসক্ত ছিল। বর্তমানে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতেও এ আসক্তি ছড়িয়ে গেছে।

মাদকাসক্তির কারণ

মাদকাসক্তির পেছনে রয়েছে নানা কারণ। তবে কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণে মানুষ মাদকাসক্ত হয় না। অনেকেই কৌতূহল বশে মাদক গ্রহণ শুরু করলেও পরবর্তীতে এই আসক্তি জীবনের জন্য মারাত্মক অভিশাপ জেনেও এর শৃঙ্খল থেকে বের হতে পারে না। অনেক সময় ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও নানাবিধ আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি মানুষকে এ অভিশপ্ত জীবনের দিকে ঠেলে দেয়। মাদকাসক্তির পেছনে প্রধান যে কারণগুলো দায়ী তা হলোঃ
  • কৌতূহল মেটাতে।
  • আসক্ত বন্ধু-বান্ধবের চাপে পড়ে।
  • পারিবারিক অশান্তির কারণে।
  • বেকারত্ব ও নিঃসঙ্গতা থেকে।
  • নানাবিধ কারণে জীবনে হতাশা ও দুঃখবোধ থেকে।
  • পারিবারিক বন্ধনে শিথিলতা, নিয়ন্ত্রণহীনতা থেকে।
  • মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা।
  • মাদক কারবারিদের সংস্পর্শ।
  • চিত্ত-বিনোদনের অভাবে।
  • জীবনে একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা।
  • সাময়িক ভালো লাগার আকর্ষণ।
  • প্রেমঘটিত কারণে।
আধুনিক মনোবিজ্ঞানীদের মতে, সুস্থ বিনোদনের অভাবে মানুষ নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে।

মাদকাসক্তির পরিণাম

মাদকাসক্তির পরিণাম তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। মাদকের নেশায় আচ্ছন্ন মানুষ নানারকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আসক্ত ব্যক্তির আচার-আচরণে দেখা যায় অস্বাভাবিকতা। স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে। অনুভূতি ও মননশক্তি হয়ে যায় অসাড়। কাজের ক্ষমতা লোপ পায়। সেই সাথে নানারকম রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। মাদকাসক্ত ব্যক্তির ভালো কাজের প্রতি অনীহা ও মন্দ কাজের প্রতি আকর্ষণ এবং মূল্যবোধের অবক্ষয় সমাজ জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি যেহেতু পরিবারের বাইরেও সামাজিক জীবনযাপন করেন, সেহেতু এর প্রভাব ব্যক্তি ও পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে সমগ্র আর্থ-সামাজিক কাঠামোর ওপর পড়ে আর আসক্তিজনিত কুফলগুলো দ্বারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সংক্রমিত হয়। দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।

বাংলাদেশে মাদকাসক্তির প্রভাব

বাংলাদেশে মাদকাসক্তির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য চোরাচালানকারীদের ব্যবসায়ের জন্য লোভনীয় স্থান এখন এ দেশ। বিশেষভাবে আমাদের যুবসমাজের একটা বিরাট অংশ মারাত্মকভাবে ঝুঁকে পড়ছে মাদকের দিকে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুবসমাজ বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়ছে। চোরাচালান বাড়ছে এবং দেশের কর্মক্ষম জনশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শুধু মাদকের প্রভাবে।

ঘটছে সম্পর্কের বিপর্যয় ও পারিবারিক অশান্তি। অসংখ্য মানুষ হৃদরোগ, যক্ষ্মা, ফুসফুসে পানি জমা, লিভারের জটিলতা, কিডনি রোগ, অপুষ্টি, ক্ষুধামন্দা, রক্তহীনতা, মস্তিষ্ক বিকৃতি, ক্যানসার, বন্ধ্যাত্বসহ নানারকম রোগে ভুগছে মাদকের কারণে। শারীরিক সমস্যার বাইরে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও এ কারণে বেড়ে যাচ্ছে। সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে মানবিক বন্ধন ও শৃঙ্খলতা ভেঙে পড়ছে। সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। সমাজ জীবন ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে।

মাদকাসক্তি প্রতিরোধ

মাদকাসক্তি সমাজজীবনে এক নির্মম অভিশাপ। তাই এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে বিশ্ব বিবেক আজ সচেতন। বিশ্বের দেশে দেশে সংগঠিত হচ্ছে মাদকবিরোধী আন্দোলন। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। সর্বগ্রাসী মাদকের ভয়াল থাবা থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করার জন্য গ্রহণ করা হয়েছে বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগ। এগিয়ে এসেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সমাজসেবী সংস্থা। সরকারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন জেলায় তৈরি করা হয়েছে বেশ কিছু নিরাময় কেন্দ্র। মাদক চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের মতো কঠোর আইন হয়েছে। মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং মাদকাসক্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে যেসব বিষয়ের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তা হলোঃ
  • মাদকাসক্তদের অবজ্ঞা না করে তাদের শারীরিক এবং মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা।
  • মাদক ব্যাবসা ও চোরাচালানের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা।
  • ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি।
  • সুস্থ বিনোদনমূলক কার্যক্রমের বিস্তার ঘটানো।
  • মাদকাসক্তির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে গণসচেতনতামূলক প্রচারণার ব্যবস্থা করা।
  • মাদকদ্রব্য চোরাচালান রোধ করার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে গণআন্দোলন গড়ে তোলা।
  • সর্বস্তরের পাঠসূচিতে মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব অন্তর্ভুক্ত করা।
  • বন্ধুত্বপূর্ণ পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি করে।

উপসংহার

মাদকের অপশক্তি সবচেয়ে বেশি গ্রাস করছে তরুণসমাজকে। সুতরাং মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারের অর্থই হলো দেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিপর্যস্ত হয়ে পড়া। তাই বিপর্যয় শুরু হওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। মাদকের অপশক্তির বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে ব্যাপক আন্দোলন। এ দায়িত্ব পরিবারের, সমাজের এবং রাষ্ট্রের।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url