রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রচনা- রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র (সমস্যা ও সম্ভাবনা)
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হলো ২.৪ গিগাওয়াট।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার
রূপপুরে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই বিদ্যুৎ
কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট ২০২৪ সালে কার্যক্রম শুরু করে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ
কেন্দ্রটি নির্মিত হয় রাশিয়ার রোসাটোম স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি কর্পোরেশন-এর
সহযোগিতায়।
সূচিপত্রঃ- রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রচনা- রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র (সমস্যা ও সম্ভাবনা)
- ভূমিকা
- পরমাণু বিদ্যুৎ কী
- রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
- বাংলাদেশ ও রাশিয়া পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর
- পরমাণু জ্বালানির সম্ভাবনা
- পারমাণবিক জ্বালানির অসুবিধা
- পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদা
- উপসংহার
ভূমিকা
আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার বিদ্যুৎ মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কালজয়ী অধ্যায়ের
সূচনা করেছে। আমাদের ব্যক্তিজীবনের কাজকর্ম, বিনোদন, আরাম-আয়েশ সব কিছুই সম্ভব
হয়েছে একমাত্র বিদ্যুতের কারণে। কিন্তু বিদ্যুতের অভাবে আমাদের জীবন নিষ্প্রাণ,
নিষ্ফল ও অর্থহীন হয়ে পড়ে। মোটকথা, আধুনিক জীবনের সবক্ষেত্রে বিদ্যুৎশক্তিই হলো
সাফল্যের চাবিকাঠি।
পরমাণু বিদ্যুৎ কী
পরমাণু বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এ
প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজাত ইউরেনিয়াম অথবা থোরিয়াম-এর নিউক্লিয়াস ভেঙে দুটি
ক্ষুদ্রতম অংশে বিভক্ত হয়ে শক্তি সৃষ্টি করে এবং দুটি অথবা তিনটি নিউট্রন
নির্গত করে। এ ফিউশান পদ্ধতির মাধ্যমে চেইন রি-অ্যাকশন সৃষ্টি করা যায়। ফলে এই
শক্তি এক বিরাট তাপের সৃষ্টি করে যাকে পরবর্তী সময়ে বিদ্যুতে পরিণত করা যায়। এ
বিদ্যুৎকেই পরমাণু বিদ্যুৎ বলা হয়। এর শক্তি এত বেশি যে এক কিলোগ্রাম
ইউরেনিয়ামে যে শক্তি তা দুই হাজার ৫০০ টন কয়লা পোড়ালে যে শক্তি হবে তার সমান। এ
পদ্ধতি অত্যন্ত কঠিন, জটিল ও বিপজ্জনক। এর জন্য দরকার দক্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবশ্য এর ব্যতিক্রম ঘটিয়ে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি করা হয়েছিল।
তার পরপরই ১৯৫০-এর দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার 'Atom For Peace'
অর্থাৎ শান্তির জন্য অ্যাটম কর্মসূচি হাতে নেন। ফলে গড়ে ওঠে 'আন্তর্জাতিক আণবিক
শক্তি সংস্থা'। এর তত্ত্বাবধানে পরবর্তী সময়ে আণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার
হয় পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালেই বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এরপর থেকে
আণবিক শক্তি সংস্থা বহুভাবে বহুমাত্রিক সাহায্য করে যাচ্ছে বাংলাদেশ পরমাণু
শক্তি কমিশনকে। পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে আমেরিকা, ফ্রান্স, জাপান,
কোরিয়া, চীন, তুরস্ক এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তি
করেছে। পরমাণু বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা শুধু যে আজকের প্রতিপাদ্য, তা
নয়-স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশে এর প্রয়োজনীয়তার কথা আমাদের দেশের পরমাণু
বিজ্ঞানীরা বলেছেন। এমনকি পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশন যখন ১৯৬১ সালে পারমাণবিক
বিদ্যুতের বিষয় মাথায় আনে, তখন থেকেই বিষয়টি প্রাধান্য পায়। ১৯৬২ সালে পাবনা
জেলার ঈশ্বরদী থানার পদ্মা নদী তীরবর্তী রূপপুর-কে দেশের প্রথম পারমাণবিক
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। এজন্য একাধিক সমীক্ষার
মাধ্যমে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচই করা হয়। কিন্তু প্রকল্পের কাজ আংশিক সম্পন্ন
হতেই তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ২০০ মেগা-ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ প্রকল্প
বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেয়। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৬ সময়কালে মেসার্স সোফরাটম
কর্তৃক পরিচালিত ফিজিবিলিটি স্টাডির মাধ্যমে রূপপুর পরিমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প
বাস্তবায়ন যৌক্তিক বলে বিবেচিত হয়। ফলে একনেক কর্তৃক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
(১২৫ মেগা-ওয়াট) নির্মাণ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। কিন্তু
বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯৮৭-১৯৮৮ সালে জার্মানি
ও সুইজারল্যান্ডের দুটি কোম্পানি কর্তৃক দ্বিতীয়বার ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়।
উক্ত স্টাডির মাধ্যমে প্রকল্পের আর্থিক ও কারিগরি যৌক্তিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
এ স্টাডিতে ৩০০-৫০০ মেগা-ওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা
হয়। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. এম. এ.
ওয়াজেদ মিয়া কর্তৃক ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ
প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার
পাওয়ার অ্যাকশন প্লান-২০০০ অনুমোদিত হয়। সর্বশেষ ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের
নির্বাচনি ইশতেহারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা
হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের
পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে।
বাংলাদেশ ও রাশিয়া পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে কাঙ্ক্ষিত স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার
পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ও এর যথোপযুক্ত ব্যবহারে বিশেষ নজর দিচ্ছে। বর্তমানে
দেশের শতভাগ জনগণ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় রয়েছে। দেশে বর্তমানে মাথাপিছু বিদ্যুৎ
উৎপাদনের পরিমাণ ৫৬০ কিলোওয়াট ঘণ্টা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকগুলো
বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বাণিজ্যিকভাবে চালু করেছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
নির্মাণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার সাথে ২০০৯ সালে ১৩ই মে একটি প্রাথমিক
চুক্তি স্বাক্ষর করে। যাতে বলা হয় ১ হাজার মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
নির্মাণ করতে হবে। এতে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয় ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০০৯ সালের
২১শে মে মস্কোয় বাংলাদেশ ও রাশিয়া পরমাণু জ্বালানির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের
ক্ষেত্রে সহযোগিতা কাঠামো চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়।
পরমাণু জ্বালানির সম্ভাবনা
পরমাণু জ্বালানি সম্পর্কে বলা হয় এ জ্বালানির মাধ্যমে কার্বন নির্গমন হয় কম। যা
পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে না। ভারতে কয়লা পোড়ানোর ফলে সেখানে কার্বন নির্গমন
হয় এক বছরে ২৭৯ দশমিক ৬১ ও বাংলাদেশে ৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন, পরমাণু
বিদ্যুৎ প্রকল্পের সবচেয়ে বড়ো সুবিধা হলো কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন। আর এই
বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে আলোকিত হবে বাংলাদেশ। এই বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে গ্রাম থেকে
গ্রামে।
পারমাণবিক জ্বালানির অসুবিধা
পারমাণবিক চুল্লির যেমন সুবিধা রয়েছে তেমনি রয়েছে অসুবিধাও। একটি পারমাণবিক
শক্তির চুল্লি স্থাপনের পূর্বে অঞ্চলের পরিবেশ, ভূকম্পন প্রবণতা, হাইড্রোলজি,
আবহাওয়াবিদ্যা, জনসংখ্যা এবং শিলু পরিবহন ও সামরিক স্থাপনাসমূহ নিয়ে গভীরভাবে
চিন্তা করতে হবে। এ ছাড়া অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণ, বিকিরণ ও দুর্ঘটনার কারণে
মহাবিপর্যয় ঘটতে পারে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণে আন্তর্জাতিক
মানের নিউক্লিয়ার বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্ঘটনার ফলে
ক্যানসারজনিত রোগের সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। যেসব স্থানে এ ধরনের দুর্ঘটনা
ঘটে সেসব স্থানে জন্ম নেয়া সকল শিশুই শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়। জমির
উর্বরতা চিরদিনের জন্য বিনিষ্ট হয়। পারমাণবিক চুল্লিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার পর
সৃষ্ট হয় তেজস্ক্রিয় বর্জ্য যা জীবজগৎ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক। যতই
নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক না কেন তার পরেও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও
কারিগরি ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনার আশঙ্কা কমবেশি থেকে যায়। পারমাণবিক শক্তির
প্রধান উৎস ইউরেনিয়াম। বৈজ্ঞানিকদের ধারণা, আগামী ৪০ থেকে ৬০ বছর পর আর
ইউরেনিয়াম পাওয়া যাবে না। পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ খুবই ব্যয়বহুল ব্যাপার।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদা
বিশ্বের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১৬% আসে পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে। বিশ্বের ৩০টি
দেশের ৪৪৯টি পারমাণবিক চুল্লিতে এই বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের
একারই রয়েছে ১০৪টি রিয়েক্টর যেখানে উৎপাদন হার তাদের ২০% বিদ্যুৎ। ফ্রান্সে
৫৯টি রিয়েক্টর দেশের মোটে উৎপাদনের ৭৮% বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। বর্তমানে যেসব দেশে
আরও রিয়েক্টর নির্মাণাধীন রয়েছে, তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে চীন ও ভারত। ভারতে
বর্তমানে ২১টি পরমাণু চুল্লি রয়েছে। যার একটি বাদে সবকটি চালু রয়েছে। বর্তমানে
ভারতের মাত্র ৩ শতাংশ চাহিদা মোট পরমাণু বিদ্যুতে, বেলজিয়ামের ৫৮টি
বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পাচ্ছে ৫৮% শতাংশ। চীন এ খাত থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন
করছে ৩০ হাজার মেগাওয়াট। পাকিস্তান ৪২৫ মেগাওয়াট। ২০২৪ সালের মধ্যে ভারত ২৭,৪৮০
হাজার এবং চীন ৪০ হাজার মেগাওয়াটের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে।
উপসংহার
বর্তমানে বাংলাদেশে দিন দিন বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বেড়ে চলেছে।
এমতাবস্থায় এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সরকার পরমাণু বিদ্যুৎ
উৎপাদনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ সম্পন্ন
হলে ২০২৩ সালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে।
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url