কৃষিতে বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং কৃষক-বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক

সূচনা
কৃষকদের ঐকান্তিক চেষ্টা ও অক্লান্ত শ্রমেই বাংলাদেশ সোনার ফসলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিষয়টি উপলব্ধি করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ একদা এ দেশকে 'সোনার বাংলা' আখ্যা দিয়েছিলেন। কেননা, তখন কৃষি ও কৃষকই ছিল এ দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো গঠন ও উন্নয়নের প্রধান কান্ডারি। শুধু তা-ই নয়, আজও বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকাংশেই কৃষিনির্ভর। তাই কৃষির ওপরই এ দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করছে। এজন্য জাতীয় ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কৃষির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক সমাজ

প্রাগৈতিহাসিক কালেই পৃথিবীতে কৃষির সূচনা হয়। সে সময় থেকেই মানুষ কৃষিকর্মের গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং কৃষির মানোন্নয়নে মনোনিবেশ করে। সভ্যতার ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অন্য সব বিষয়ের মতো কৃষিব্যবস্থার উন্নয়নেও মানুষ ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করেছে। আর তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের কৃষিতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আধুনিককালে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির ফলে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই কৃষিব্যবস্থার আধুনিকায়ন হয়েছে। এর ফলে শিল্প ও কৃষির পারস্পরিক মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে তরান্বিত হচ্ছে উন্নয়ন। তবুও বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত শিক্ষা আর কৃষিকর্মের আধুনিকায়ন থেকে বঞ্চিত। এ কারণে এ দেশের কৃষি সেভাবে বিকশিত হতে পারছে না। যদিও কিছুক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে কৃষকদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই সীমিত।

বাংলাদেশের কৃষক বলতেই এখনো অশিক্ষিত, শীর্ণকায় ও দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত অবহেলিত একটি গোষ্ঠীকে বোঝায়। যারা আজও অস্থিচর্মসার একজোড়া বলদের ওপর নির্ভর করেই চাষাবাদ করে। এর ফলে এ দেশের কৃষি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়ে অতি মন্থর ও স্থবির পেশায় পরিণত হচ্ছে। আর এভাবে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে অনেকেই কৃষিকাজ ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা, এখনই কৃষিক্ষেত্রের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়ে কৃষকদের হৃদয়ে আশার সঞ্চার করতে না পারলে একসময় এ দেশের কৃষিব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশের কৃষক ও কৃষির গুরুত্ব

বাংলাদেশের কৃষকদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যই দেশের বেশিরভাগ খাদ্যশস্যের জোগান দেয়। অথচ অনেকক্ষেত্রেই আমাদের স্মরণে থাকে না যে, এ দেশের কৃষক সমাজ যদি অক্লান্ত পরিশ্রম করে ফসল না ফলাত তাহলে আমাদের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থানই হয়তো সম্ভব হতো না। তাছাড়া আমাদের জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে কৃষিপণ্য যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, তা মূলত সম্ভবপর করেছে এ দেশের কৃষক সমাজ। তাদের চেষ্টায় প্রতি বছর বাংলাদেশ কৃষিপণ্য রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। উল্লেখ্য যে, ২০২০-২১ অর্থবছরের কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ আয় করেছে ১০৩ কোটি মার্কিন ডলার।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে (জুলাই- নভেম্বর) ৫৫ কোটি ৬৪ লাখ মার্কিন ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানির মাইলফলক অর্জন করে। এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এই আয় ২৪ দশমিক ৩৭ শতাংশের বেশি। আমাদের দেশের রপ্তানিযোগ্য প্রধান কৃষিপণ্যগুলো হলো- বিভিন্ন রকমের মৌসুমি ফল ও শাক-সবজি, দুগ্ধজাত পণ্য, তেল প্রভৃতি। কৃষকদের উৎপাদিত এ সকল কৃষিপণ্য দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বৈদেশিক অর্থ উপার্জনেও প্রভূত অবদান রাখছে। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে কৃষক ও কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম।

কৃষি আর কৃষকদের অতীতাবস্থা

অতীতে বাংলাদেশে জনসংখ্যা কম থাকায় চাষাবাদের জন্য কৃষকের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ আবাদি জমি ছিল। সে সময় এ দেশের পলি ও দোঁআশ মাটিযুক্ত জমিগুলো ছিল খুব উর্বর। তাই কোনোরূপ রাসায়নিক সার বা কীটনাশক প্রয়োগ না করেই ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হতো। এছাড়া সে সময় কীটপতজোর উপদ্রব কম থাকায় সহজেই ফসল ফলত। কিন্তু তখনকার কৃষিব্যবস্থা অনেকাংশেই ছিল প্রকৃতিনির্ভর। ফলে খরা বা বন্যার মতো দুর্যোগে তাদেরকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হতো। তাছাড়া সঠিক উপায়ে চাষাবাদ না করায় এবং বৃষ্টির অভাবে ঠিকমতো সেচের ব্যবস্থা করতে না পারায় অনেক সময় তারা ভালো ফলন পেত না। তবুও অল্প জনসংখ্যা আর পরিমিত চাহিদার কারণে সে সময়ে তারা কায়ক্লেশে কোনোরকম জীবিকা নির্বাহ করত।

বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষক সমাজ

বাংলাদেশের কৃষকদের মধ্যে কিছুসংখ্যক কৃষক বর্তমানে আধুনিক কৃষি সরঞ্জামসহ বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর বিপরীত চিত্রটিই চোখে পড়ে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে দেশে আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার, কারণে কৃষকরা দিন দিন ভূমিহীন হয়ে পড়ছে। ফলশ্রুতিতে অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করতে গিয়ে লাভবান হতে না পেরে কৃষিকাজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। তাছাড়া প্রয়োজনীয় কৃষি সরঞ্জাম ক্রয়সহ কীটনাশক বা সার ব্যবহারের অধিক ব্যয় কৃষকদেরকে হতাশাগ্রস্ত করে তুলছে। এমতাবস্থায় সরকারিভাবে কৃষক সম্প্রদায়কে অধিক সহযোগিতা প্রদান অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। অবশ্য কিছুক্ষেত্রে কৃষকদের সফলতার চিত্রও চোখে পড়ছে কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় তা সীমিত।

বাংলাদেশের কৃষির দুরবস্থার কারণ

বাংলাদেশের কৃষির সবচেয়ে বড়ো সমস্যাটি হলো, এ দেশের অধিকাংশ কৃষক এখনো সনাতন পদ্ধতিতেই চাষাবাদ করছে। উন্নত দেশগুলোর কৃষকদের মতো বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক শিক্ষায় তারা প্রশিক্ষিত নয়। এছাড়া দিন দিন জমির উর্বরতাশক্তি হ্রাস পাওয়ার কারণে বর্তমানে সহজে জমিতে ভালো ফসল ফলছে না। অধিকন্তু এ দেশের কৃষকদের পর্যাপ্ত নিজস্ব জমি নেই বলে অনেক সময় মহাজনদের কাছ থেকে জমি বর্গা নিয়ে তাদেরকে চাষাবাদ করতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের শিকার হতে হচ্ছে এ দেশের কৃষক সমাজকে।

অবস্থা এমন যে অনেকক্ষেত্রে ফসলের নামমাত্র মূল্য পাচ্ছে তারা। দেশের ভোগবিলাসী ধনকুবেরদের দৌরাত্ম্য এবং রাজনৈতিক অপকৌশলও এ দেশের কৃষি ও কৃষক সমাজকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন- জলোচ্ছ্বাস, খরা, ঘূর্ণিঝড় এসবের কারণেও এ দেশের কৃষি ও কৃষকসমাজ প্রতিবছর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রয়োজনীয় এবং যুগোপযোগী কৃষি সরঞ্জাম, উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক ও সেচের ব্যবস্থা না থাকাও এ দেশে কৃষির দুরবস্থার একটি অন্যতম প্রধান কারণ।

দুরবস্থা থেকে কৃষি ও কৃষকের উত্তরণের উপায়

বাংলাদেশের কৃষিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও বেশি যত্নবান হতে হবে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ইতোমধ্যেই দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একাধিক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। উদ্ভুত সমস্যা থেকে কৃষি ও কৃষকদের উত্তরণের জন্য প্রয়োজনে আরও বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রথমেই কৃষকদের জন্য আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে কৃষকদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানদান করে তাদেরকে দক্ষ করে তুলতে হবে। এছাড়া উন্নত সার, বীজ, সেচব্যবস্থা, রিপিং মেশিন, হারভেস্টিং মেশিনসহ প্রয়োজনীয় কৃষি সরঞ্জামাদি বিনা- মূল্যে বা স্বল্পমূল্যে প্রদান করার ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রাথমিক পর্যায়ে তাদেরকে অর্থনৈতিক সহায়তাদানের লক্ষ্যে সহজ শর্তে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে অতি সামান্য সুদের হার নির্ধারণসহ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সুদ মওকুফ করার ব্যবস্থাও করতে হবে। এছাড়াও কৃষকদের কষ্টার্জিত ফসল যাতে সঠিক মূল্যে বিক্রি হয় তার ব্যবস্থাও করতে হবে। এছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধে যা যা করণীয় তা নিশ্চিত করতে হবে। বন্যা, খরা, ঝড়ে বা জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের হাতকে আরও প্রসারিত করতে হবে। সর্বোপরি, বিভিন্ন আগ্রাসী শক্তিকে অবদমিত করে এ দেশের কৃষি ও কৃষক সমাজকে বাঁচাতে তৎপর হতে হবে।

উপসংহার

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের কৃষি ও কৃষক বাঁচলে তবেই দেশ বাঁচবে। তাই কৃষকদের উন্নয়নের ওপর দেশের ভবিষ্যৎ অগ্রগতি অনেকখানি নির্ভর করছে। বর্তমানে একই জমিতে বারবার একই ফসল ফলানোসহ মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের কারণে ফলন কম হচ্ছে। তাছাড়া উপযুক্ত পারিশ্রমিক না পাওয়ার কারণেও কৃষকের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে পড়ছে। তাই কৃষিক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের দিকেও কর্তৃপক্ষকে জোর দিতে হবে। সর্বোপরি কৃষকের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিলে তবেই এগিয়ে যাবে দেশ। আর তাদের শ্রমনিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী হয়ে প্রকৃত সোনার বাংলা হিসেবে গৌরবময় পরিচিতি লাভ করবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url