বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক মুক্তি
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ একটি ঐতিহাসিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই যুদ্ধের
মাধ্যমে দীর্ঘদিনের শোষণ ও নিপীড়নের অবসান হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
সংঘঠিত হয়েছিলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব
পাকিস্তানের। এইট ছিলো একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম। তৎকালীন পশ্চিম
পাকিস্তান কতৃক পূর্ব পাকিস্তানের শোষণ ও নিপীড়নের প্রতিবাদে বাঙালি
জাতীয়তাবাদের উত্থান ও অধিকার আদায়ের লক্ষে এবং বাঙালি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই
জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ ও মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাঙালি
অর্জন করেছিল স্বাধীনতার সোনালি সূর্য। যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে বাঙালিরা অর্জন
করেছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের।
সূচিপত্রঃ- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক মুক্তি
- ভূমিকা
- স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা
- স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা
- বর্তমান প্রেক্ষাপট
- উপসংহার
ভূমিকা
বাঙালি জাতির সর্বাপেক্ষা গৌরবের ইতিহাস তার স্বাধীনতার ইতিহাস। ভৌগোলিক
অবস্থান ও প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে শান্তিপ্রিয় হলেও কারোর অধীনতা বাঙালি জাতি
কোনোদিন মেনে নেয়নি। অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির অবস্থান চিরকালই ছিল
প্রতিবাদী। তাই এখানে বার বার বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে। সে আগুনে বারবার
প্রকম্পিত হয়েছে পরাশক্তির ভীত ও শোষণের ভিত্তিভূমি। স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালির
আজন্ম স্বপ্ন ও সাধনা ছিল পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভ করা। আর এ বোধ ও
চেতনা থেকেই পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্তির জন্যে ১৯৭১ সালে
সর্বস্তরের মানুষ জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে এবং দীর্ঘ নয় মাসের
রক্ষক্ষয়ী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অর্জন করে প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা
অর্জনের পেছনে একদিকে যেমন সার্বভৌমত্ব রক্ষার দাবি সক্রিয় ছিল অন্যদিকে তেমনি
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জন ছিল প্রধান লক্ষ্য।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে দুটি প্রদেশ নিয়ে
নতুন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জন্ম হয়। পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার ফলে
এদেশের অনেক মানুষের প্রত্যাশা ছিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে
অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, পশ্চিম পাকিস্তানের
শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্য নীতির ফলে পাকিস্তানের সমগ্র অর্থনীতি পশ্চিম পাকিস্তানকে
কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অফিস-আদালত
সবই পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পরিচালিত হতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের
জনতা এ অর্থনৈতিক বৈষম্য মেনে নিতে পারেনি ফলে স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা
যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য ছিল
সবচেয়ে মারাত্মক। পূর্ব পাকিস্তানের সমাজ কাঠামো মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত
শ্রেণিভিত্তিক, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সমাজ কাঠামো ছিল ভূস্বামী,
পুঁজিপতি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিভিত্তিক। সমাজ কাঠামোর এ বৈপরীত্যের কারণে পশ্চিম
পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর শোষণের হাত প্রসারিত করে এবং কেন্দ্রীয়
শাসনতন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানিদের যোগ্য প্রতিনিধি না থাকায় পূর্ব
পাকিস্তানবাসীরা শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয় বেশি। ১৯৪৭-৭০ সাল পর্যন্ত দুই
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- আমদানি খাতে পূর্ব
পাকিস্তানে ব্যয় হতো ৬৩০ কোটি টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হতো ৩৭৯৯ কোটি
টাকা।
শাসন খাতে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যয় ২৬৯ কোটি টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যয়
ছিল ১৯৪৭ কোটি টাকা। উন্নয়নমূলক খাতে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যয় ছিল মাত্র ২১১৪
কোটি টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যয় ছিল ৫৩৯৫ কোটি টাকা। পূর্ব পাকিস্তানের
মাথাপিছু আয় ছিল ৩৩১ টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ৫৩৩ টাকা। এ ছাড়াও
শিল্পকারখানা সবই প্রতিষ্ঠিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে একমাত্র
আদমজি জুটমিল ব্যতীত (বর্তমানে বন্ধ) উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো
শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল না বললেই চলে। এ ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফলে পূর্ব
পাকিস্তানের জনগণ স্বাধীনতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী এক
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করে স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা
যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের যুদ্ধের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে প্রায় এক দশক সময় লেগে
যায়। ধীরে ধীরে এদেশের কৃষি ও বাণিজ্যিক অর্থনীতির ধারা উন্নতির দিকে এগিয়ে
যায়। সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে ছোটো-বড়ো
শিল্পকারখানা। বাংলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক,
সরকারি, আধাসরকারি ও প্রাইভেট মিলে কয়েক ডজন বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত
হয়েছে।
মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে এদেশের চা, বস্ত্রশিল্প, পাটজাত সামগ্রী বিদেশে
রপ্তানির মধ্য দিয়ে অর্জিত হচ্ছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। জনশক্তি রপ্তানির
মাধ্যমেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে বর্তমানে
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো খাত হচ্ছে তৈরি পোশাকশিল্প। স্বাধীনতার পর থেকে
বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক এগিয়েছে। তবে দুর্নীতি, ঘুষ ও অরাজকতার কারণে
কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন আজও সম্ভব হয়নি। আশার কথা হচ্ছে বর্তমান
সরকার দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্য অনেকটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
যে স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সেই স্বপ্ন নানা
কারণেই গত ৫২ বছরেও সাফল্যের লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে পারেনি। স্বাধীনতার পর
বারবার সামরিক অভ্যুত্থান, হত্যা আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল,
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের অপতৎপরতা, অর্থনৈতিক
বৈষম্য, যুবসমাজের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা, বেকারত্ব, জনস্ফীতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি,
ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদির ক্রমবৃদ্ধির ফলে ব্যাহত হচ্ছে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন।
ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের মূল পরিকল্পনাই ভেস্তে যাচ্ছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পরিকল্পিত বাজেট প্রণয়ন, কলকারখানা,
শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, বিজ্ঞানসম্মত কৃষিব্যবস্থা প্রণয়নের মাধ্যমে এগিয়ে
নিতে হবে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে।
উপসংহার
সামগ্রিক আলোচনা থেকে আমরা এ সত্যে উপনীত হতে পারি যে, অর্থনৈতিক মুক্তি ও
সাম্য প্রতিষ্ঠার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৭১ সালে আমরা যে কঠিন আত্মত্যাগের
মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, তা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের
চেতনা তখনই সাফল্যে উদ্ভাসিত হবে যখন রাজনৈতিক স্বাধীনতা আর্থসামাজিক,
সাংস্কৃতিক স্বাধীনতায় রূপান্তরিত হবে। সেই লক্ষ্যে আজ সমাজের সর্বস্তরে
মুক্তিযুদ্ধের মহান চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। দেশের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে
মুক্তিযুদ্ধের মহৎ লক্ষ্যসমূহ সঞ্চারিত করা গেলে তবেই আমাদের স্বাধীনতা
সত্যিকার অর্থে এক গৌরবময় স্তরে উত্তীর্ণ হবে।
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url