খাদ্যে ভেজাল ও তার প্রতিকার

সূচনা
মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল হলো খাদ্য। সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে খাদ্যকে মৌলিক উপকরণ এবং ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে খাদ্যকে জীবনের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে আজ ভেজাল খাদ্যের পরিমাণ এত বেড়ে গেছে যে, তৈরি অথবা কাঁচা কোনো খাদ্যদ্রব্যের ওপরই মানুষ আর আস্থা রাখতে পারছে না। মাছ-মাংস, সবজি-তরকারি, ফলমূল ও বিভিন্ন বিপণির তৈরি খাবার, এমনকি শিশুখাদ্যে পর্যন্ত ভেজাল মেশাতে কার্পণ্য করছে না অসাধু ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে টিভিতে প্রতিনিয়ত আমরা রিপোর্ট হতে দেখছি এবং কিছু কিছু বিজ্ঞাপনের চিত্রায়ণের মধ্য দিয়ে খাদ্যে ভেজালের আসল রূপও আমাদের সামনে প্রকটিত হচ্ছে। কিন্তু জীবন সংকট বা স্বাস্থ্য সংকটকে আমলে নিয়েও একশ্রেণির মানুষ নিয়মিতই খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে যাচ্ছে।
খাদ্যে ভেজালের কারণ
খাদ্যে ভেজালের কারণটিকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পর্যালোচনা করলে দুটি বিষয় আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। যেমন- (ক) মনস্তাত্ত্বিক কারণ (খ) সামাজিক কারণ।
(ক) মনস্তাত্ত্বিক কারণঃ মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড মানুষের অপরাধ করার কিছু লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন তাঁর 'মনোবিকলন তত্ত্ব' নামক গ্রন্থে। তাঁর মতে, মানুষের অসমর্থতা বা অকৃতকার্যতা অথবা অযাচিত লোভ তাকে অপরাধ করার ইন্ধন জোগায়। লোভের বশবর্তী হয়েই মানুষ এ অপরাধ করে। সম্পদ লাভের অদম্য ইচ্ছা বা অসম প্রতিযোগিতা মানুষকে এই ধরনের কাজ করতে প্ররোচিত করে। যেহেতু খাদ্যদ্রব্য একটি অতি প্রয়োজনীয় ও স্পর্শকাতর বিষয়, তাই এতে ভেজাল মিশিয়ে মানুষকে খুব সহজেই প্রতারিত করা সম্ভব। আর এ সুযোগটিকে গ্রহণ করে ঐ অসাধু গোষ্ঠী দিনের পর দিন মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
(খ) সামাজিক কারণঃ খাদ্যে ভেজালের সামাজিক কারণটি অত্যন্ত বিস্তৃত। তার মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে উত্তরোত্তর জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মানুষের মধ্যেকার অসম প্রতিযোগিতা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সীমিত খাদ্যের ওপর যখন চাপ বাড়ে, তখন ভেজাল মিশিয়ে তার পরিমাণ বৃদ্ধি বা মেয়াদ বৃদ্ধি করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যে অসাধু ব্যবসায়ীরা ভেজাল মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করে। আর অসম প্রতিযোগিতার ফলে এসব খাদ্যদ্রব্যই চড়া মূল্যে বিক্রি হয়। এ কারণে ভেজালে সয়লাব হয়ে যায় বাজার, কিন্তু মানুষ তা টেরও পায় না বা পেলেও কিছু করতে পারে না।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে খাদ্যে ভেজাল
সমগ্র বিশ্বে খাদ্যে ভেজালের একটি প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। উন্নত দেশগুলোর চেয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ প্রবণতা অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে ক্যানসারসহ অন্যান্য প্রাণঘাতী অসুখ সমূহের অন্যতম কারণ হচ্ছে এই ভেজাল খাদ্য। আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের দেশগুলোতে জনসংখ্যা অপরিকল্পিতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে খাদ্যদ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং ভেজাল মেশানোর প্রবণতাও অধিকহারে বেড়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পূর্বেই গণমাধ্যমের একটি খবরে আমাদের সবার চোখ আটকে গিয়েছিল। চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে যে শিশুখাদ্য বাংলাদেশে আসতো (বিশেষ করে গুঁড়ো দুধ) তাতে 'মেলামিন' নামক একটি উপাদানের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে তা শিশুস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। এছাড়া কিছুদিন পূর্বেই ভারতে বিশ্বখ্যাত 'নেসলে' ব্র্যান্ডের ম্যাগি নুডল্স-এ সিসার উপস্থিতি লক্ষ করে ভারতজুড়ে ম্যাগি নুডুলস নিষিদ্ধ করা হয়। এছাড়া কোকাকোলার মতো সমস্ত বিশ্বে সুপরিচিত কোমল পানীয়তেও স্বাস্থ্যের ভয়াবহ হুমকি হতে পারে এমন উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে খাদ্যে ভেজালের প্রকৃতি
আমাদের দেশে বিচিত্রভাবে খাদ্যে ভেজাল মেশানো হয়। ফলে বিশ্বাস করে কোনো খাদ্য কেনাই সম্ভব হয়ে ওঠে না। আম, আনারস, কলা, পেঁপেসহ বিভিন্ন ফল ক্যালসিয়াম, কার্বাইড, ইথেল ও ইথালিন দিয়ে কৃত্রিমভাবে পাকানো হয়। আমদানিকৃত ফল (আপেল, আঙ্গুর, নাশপাতি ইত্যাদি) তাজা রাখার জন্য ফরমালিন ব্যবহার করা হয়। দুধের মাখন তুলে বা পানি মিশিয়ে ভেজাল দুধ বিক্রি হয়। আবার মহিষের দুধ পানি মিশিয়ে পাতলা করে গরুর দুধ বলে বিক্রি করা হয়ে থাকে। মুড়ি সাদা ও মচমচে করার জন্য ব্যবহার করা হয় ইউরিয়া। তরমুজের ভেতরে সিরিঞ্জ দিয়ে রং প্রবেশ করানো হয় দেখতে সুন্দর লাগার জন্য। পটল, করলা, লালশাকসহ অন্যান্য সবজিতে টেক্সটাইল রং ব্যবহার করা হয় সুন্দর রাখার প্রয়োজনে। মাছে মেশানো হচ্ছে জীবন ধ্বংসকারী ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথেফেন, প্রোফাইল প্যারা টিটেনিয়াম পাউডারসহ নানা ক্ষতিকর উপাদান। মাছ হিমায়িতকরণের জন্য বরফ পানিতে ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। যার ফলে ফরমালিন মাছের খোলসে মিশে যাচ্ছে। জিলিপি, লাড্ডু ও সন্দেশে আলকাতরা দিয়ে তৈরি মেটালিক ইয়োলো রং ব্যবহার করা হয়। সাদা রঙের রসগোল্লা মিষ্টিতে সাদা রঙের টিস্যু ব্যবহার করা হয় সুন্দর গড়ন দিতে। এছাড়া চাল, ডালসহ শুকনো খাদ্যশস্যে বালি, কাঁকর ব্যবহার করা হয় ওজন বৃদ্ধি করার জন্য। ঘিয়ের সঙ্গে পশুচর্বি মেশানো হয়। তিল বা নারিকেলের তেলের সঙ্গে বাদাম তেল বা তুলাবীজের তেল মেশানো হয়। কাঠের গুঁড়া ও ব্যবহৃত চায়ের পাতা নতুন চায়ের গুঁড়ার সঙ্গে মিশিয়ে ভেজাল তৈরি করা হয়। বিভিন্ন খোলা বা অনেক সময় নামিদামি কোম্পানির মসলার প্যাকেটেও ভেজাল মেশানো হয়। মিনারেল ওয়াটার নামে যে পানি আমরা খাই তাতে বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন রয়েছে। শুধু এখানেই শেষ নয় প্রাণরক্ষাকারী ওষুধেও এখন ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে।
ভেজাল খাদ্য গ্রহণের প্রতিক্রিয়া
ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। খুব সহজেই মারাত্মক অসুখসহ তাদের প্রাণসংকট দেখা দিতে পারে। আবার প্রাণরক্ষা করতে যে ওষুধ শিশুদের দেওয়া হয় তাতেও ভেজাল পরিলক্ষিত হয়। খাদ্যে ভেজালের কারণে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে আমাশয়, অ্যাপেনডিক্স, রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের তথ্যানুযায়ী দেশে ডায়াবেটিস, আলসার, অপুষ্টি, চর্ম ও কুষ্ঠরোগে মৃত্যুহারও ঊর্ধ্বমুখী। বাজারে সময় সময় ভেজালবিরোধী অভিযান চলছে বলে এখন পণ্য পরিবহণের ট্রাকেই ভেজাল মেশানো হচ্ছে। বিশেষ করে লিচু ও আমের মতো দ্রুত পচনশীল ফলগুলোতে উচ্চমাত্রার ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে পচনরোধ করার জন্য। ব্রয়লার মুরগির দ্রুত বৃদ্ধির জন্য উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে।
খাদ্যে ভেজালের প্রতিকার
আমাদের সংবিধানের ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নকে রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য বলে গণ্য করা হয়েছে। তাই খাদ্যের ভেজালের প্রতিকার আমাদের জন্য খুবই তাৎপর্য বহন করে। খাদ্যে ভেজালের প্রতিকারের জন্য দু'রকম ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেমন- (ক) আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে; (খ) সামাজিক সচেতনতা গ্রহণের মাধ্যমে।
(ক) আইনি প্রতিকারঃ যেহেতু আমাদের সংবিধানে খাদ্যকে জীবনের মৌলিক উপকরণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাই এ নিয়ে বিশেষ কিছু আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে। ফৌজদারি আইনে খাদ্যে ভেজাল মেশানো একটি ভয়াবহ অপরাধ। দণ্ডবিধির ২৭২ ও ২৭৩ নম্বর ধারায় ভেজাল খাদ্য প্রস্তুত ও বিক্রয়ের জন্য ৬ মাসের কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। দুধ এবং রুটি জাতীয় খাবার খোলা অবস্থায় বিক্রি করলে ৪৪ ধারায় শাস্তির বিধান রয়েছে। বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ এর ২৫ (গ) ধারায় খাদ্যে ভেজাল মিশ্রিত করলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়া ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ভ্রাম্যমাণ আদালত যেকোনো স্থানে যেকোনো সময় খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।
(খ) সামাজিক প্রতিকারঃ সামাজিকভাবে সচেতনতা ও মূল্যবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে খাদ্যে ভেজালের প্রতিকার করা যেতে পারে। পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে বাজারে ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। যেসব খাদ্যে ভেজাল মেশানো হয় সম্ভব হলে সম্মিলিতভাবে সেগুলো বর্জন করার চেষ্টা করা যেতে পারে। এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান এসব কর্মকাণ্ড করছে তাদের পণ্য বর্জনের মাধ্যমেও খাদ্যে ভেজাল প্রতিকার করা সম্ভব। ধর্মীয়ভাবে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও তাদের এহেন কুকর্ম থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েও খাদ্যে ভেজাল প্রতিকার করা সম্ভব।
উপসংহার
খাদ্যে ভেজাল মেশানো একটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অপরাধ। তাই এর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ প্রয়োজন। দেশে নিরাপদ খাদ্য পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। এ অবস্থা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এ কারণে খাদ্যে যেকোনো রকমের ভেজাল কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। খাদ্যের জন্য জনজীবনকে কোনোভাবেই হুমকির সম্মুখীন করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ভেজালরোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ভেজালের এ দুষ্টচক্র নির্মূল করতে সারা বছর নিয়মিত ভেজালবিরোধী কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url