নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ
ভূমিকা
শিক্ষা মানুষের সার্বিক বিকাশের পথ। কোনো ব্যক্তি বা জাতির অগ্রগতির মূলমন্ত্র
হলো শিক্ষা। শিক্ষা বিষয়টি একটি সর্বজনীন, ব্যাপক ও বিস্তৃত প্রসঙ্গ।
সাধারণভাবে শিক্ষা বলতে বোঝায়, জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করা। মন ও মননের উৎকর্ষ
সাধনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক অবদান
রাখার নামই হলো শিক্ষা। শিক্ষা মানুষের মধ্যে সুপ্ত মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে
তাকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নেয়। উপযুক্ত ও যথার্থ শিক্ষা মানুষকে মানবিক করে
তোলে, তার মধ্যে মূল্যবোধের জন্ম দেয়। যার ফলে মানুষ এমন কিছু বিশেষ গুণাবলি
অর্জন করে, যা তাকে ভালোমন্দ, উচিত-অনুচিত বিচার করার শক্তি দেয়, নৈতিক আদর্শের
অনুবর্তী করে তোলে। শিক্ষার মাধ্যমে সৃষ্ট এই মূল্যবোধের আশ্রয়েই গড়ে উঠেছে
আবহমান কালের মানব সমাজ।
মূল্যবোধের স্বরূপ
মূল্যবোধ হচ্ছে ইতিবাচক ও কল্যাণকর মানবিক গুণাবলির সমষ্টি। এটি মানুষের
প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় আচরিত এমন কিছু অনুসরণযোগ্য বিষয়, যা অনুসরণে মানুষের
জীবনযাত্রা হয়ে ওঠে সুন্দর, নির্মল ও বুচিস্নিগ্ধ। মূল্যবোধ তথা নৈতিক চেতনা
মানুষকে অন্যায় থেকে বিরত রাখে, পতনের পথ থেকে বাঁচায়। স্বার্থপরতার লোভনীয়
আকর্ষণ থেকে চোখকে সরিয়ে নিয়ে আত্মত্যাগের মহামন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে। মূল্যবোধের
চর্চা মানুষকে প্রবল ও দৃঢ় এক ইতিবাচক মানসিক শক্তিতে বলীয়ান করে তোলে, যার বলে
মানুষ যাবতীয় অনৈতিকতাকে না বলতে শেখে, অন্যায় ও অবৈধ পথ অবলম্বন সচেতনভাবে
পরিহার করতে শেখে। মূল্যবোধের চর্চায় গড়া প্রকৃত মানুষ কালোকে কালো, সাদাকে
সাদা বলে মূল্যায়ন করে, সমাজে যথার্থ মনুষ্যত্বের মর্যাদা নিয়ে অধিষ্ঠিত হয়।
শিক্ষিত ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষই আলোকিত মানুষ।
মূল্যবোধ অর্জনে শিক্ষার ভূমিকা
মূল্যবোধের চর্চা ও মানবিকতার উদ্বোধনে শিক্ষা তথা সুশিক্ষাই প্রধান সহায়ক
ভূমিকা রাখতে পারে। মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধের অন্যতম প্রধান উপায় হতে পারে নৈতিক
শিক্ষার প্রসার ঘটানো। শিক্ষার প্রসারে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতীয় জীবনে
সুস্থ মানসিকতা ও মূল্যবোধের চর্চার ধারা ফিরে আসতে বাধ্য। কারণ মূল্যবোধের
অবক্ষয়ের প্রধান কারণ হচ্ছে, প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং মূল থেকে
বিচ্যুত হওয়া। ফলে ন্যায়-নীতি ও মানবিকতাবোধের শিক্ষায় সকলকে শিক্ষিত হয়ে উঠতে
হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মের সারবস্তু এবং মনীষীদের জীবনী শিক্ষাসূচিতে
অন্তর্ভুক্ত করলে এসবের পরিচয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ গড়ে উঠবে।
মানুষের মানসিক বিকাশে মূল্যবোধের চর্চা ইতিবাচক দিক হিসেবে জায়গা করে নেবে।
শিক্ষাকে হতে হবে মূলত সেই বস্তু- যা সকল অনিয়ম, অকল্যাণ ও অসুন্দর থেকে আমাদের
মুক্ত রাখে এবং নিয়মে, কল্যাণে, সুন্দরে আমাদের জীবনকে ভরিয়ে তোলে। শিক্ষা সবার
সঙ্গে সবার বন্ধন রচনা করে, ফলে প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে সবার সঙ্গে
যুক্ত হওয়ার যথার্থ চর্চা ও প্রয়োগের মাধ্যমেই মূল্যবোধের ভিত্তি গড়ে ওঠে। একজন
মানুষ সাধারণ জীব থেকে আলাদা হয়ে 'মানুষ' হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রসঙ্গত স্মরণীয়
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর বক্তব্য 'মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা
করা যেতে পারে। জীব-সত্তা সেই ঘরের নিচের তলা, আর মানব-সত্তা বা মনুষ্যত্ব
উপরের তলা। জীব-সত্তার ঘর থেকে মানব-সত্তার ঘরে উঠবার মই হচ্ছে শিক্ষা'।
তাই মূল্যবোধসম্পন্ন মানবিক মানুষ গড়ে তুলতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
সাম্প্রতিক বাস্তবতা: মানব শিশু জন্মের পর থেকে শিক্ষাগ্রহণ শুরু করে এবং
জীবনব্যাপী কোনো না কোনোভাবে এই শিক্ষাগ্রহণ চলতে থাকে। কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে
প্রাকৃতিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও জরুরি। অর্থাৎ মানবজীবন গঠনে
শিক্ষা বিকল্পহীন এক অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। শিক্ষার ফলে মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে
ওঠে। তার মধ্যে জন্ম নেয় মানবিক মূল্যবোধসমূহ। ফলে একজন শিক্ষিত মানুষ হবেন
একজন মূল্যবোধসম্পন্ন মননের অধিকারী ব্যক্তি, এটাই সকলের প্রত্যাশা।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। মূল্যবোধ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সুশিক্ষা ও
নৈতিক শিক্ষার অভাবে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি অন্যায়-অবিচার চলছে। মূল্যবোধের
অভাবে শিক্ষাগ্রহণ করেও নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে ছোটো-বড়ো সবাই। সারাবিশ্বে আজ
ভোগবাদী মানসিকতার প্রসার লক্ষ করা যাচ্ছে। দেশ- কাল-ধর্মাধর্ম, কোনো কিছুতেই
আজ যেন মানুষের মনোযোগ নেই, মনোযোগ কেবল অর্থসম্পদ আর প্রভাব প্রতিপত্তির দিকে।
সকলেই মানবতা ভুলে নিজের ভেতর পশুত্বকে লালন করে চলেছে। তারা ভুলেই গেছে মানুষ
হয়ে। এ পৃথিবীতে আসার বিশেষ দায়-দায়িত্বের কথা। আমাদের দেশ ও সমাজেও প্রকৃত
শিক্ষার অভাবে মূল্যবোধের চর্চার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবক্ষয়ের সূচনা হয়েছে।
সর্বস্তরে সীমাহীন দুর্নীতি সমাজকে গ্রাস করছে। নীতি-নৈতিকতাহীন, বিবেকহীন
মানুষ আজ সদম্ভে সমাজে বিচরণ করছে, ন্যায়-নীতির গলা টিপে ধরছে। চারদিকে কেবল
ঠকানোর প্রতিযোগিতা, অন্যায় করে কে কত বড়ো রেকর্ড করতে পারে; সেই প্রতিযোগিতায়
উন্মাদ হয়ে ছুটছে সবাই। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সংক্রামক ভাইরাসের মতো সমাজ
জীবনের সর্বত্র বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। শিক্ষাজান, চিকিৎসালয়, বিচার ব্যবস্থাসহ সব
ক্ষেত্রে অবক্ষয়িত মূল্যবোধের প্রকাশ লক্ষণীয়।
মূল্যবোধ ধারণের সুফল
মূল্যবোধের চর্চা মানব চরিত্রকে করে তোলে সুষমামন্ডিত। সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে,
সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে অপরের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার মাধ্যমেই মানুষের
জীবনে মূল্যবোধের প্রকৃত প্রকাশ ঘটে। শিক্ষিত এবং মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের
সংখ্যা সমাজে যতই বাড়ে, তত সমাজ জীবন হয়ে ওঠে নিষ্কলুষ ও বাসযোগ্য। তাই
ব্যক্তির আত্মিক উৎকর্ষ এবং সামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে মূল্যবোধের লালন
ও বিকাশে বিশেষ গুরুত্ব বিদ্যমান। জাতির সগৌরব প্রতিষ্ঠার জন্য সামগ্রিকভাবে
সকল নাগরিককে মূল্যবোধসম্পন্ন হতে হবে। মূল্যবোধের চর্চায় আদর্শ জীবন গঠনের
মাধ্যমে অপরের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন সম্ভব। অন্যের সন্তুষ্টি পরোক্ষভাবে
নিজের উপকার হয়েই ফিরে আসবে। ফলে মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ নিজের ও সমাজের জন্য
অশেষ সুফল বয়ে আনতে পারে।
উপসংহার
ভোগবাদী বিশ্বে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে প্রতিনিয়ত। অথচ অনাগত ভবিষ্যৎকে সফল ও
সুন্দর করে তুলতে মূল্যবোধের চর্চা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কেবল শিক্ষাই পারে
যথার্থ মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করতে। শিক্ষার সাহায্যে মূল্যবোধের ভিত্তিকে
সুদৃঢ় করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি, দেশ ও সমাজের কল্যাণ সাধন সম্ভব। ফলে আমাদেরকে
শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে এবং সুশিক্ষাজাত মূল্যবোধের সাহায্যে মানবিকতার উদ্বোধন
ঘটিয়ে নিষ্কলুষ বিশ্ব নির্মাণের পথে অগ্রসর হতে হবে। শিক্ষা ও মূল্যবোধের
পরিপূরক সম্পর্ককে স্বীকার করে নিয়েই তা সম্ভব।
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url