শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশ

সূচিপত্রঃ- শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশ
শিশু
প্রারম্ভিক শৈশবকাল
সম্পূর্ণ শিশুর বৈশিষ্ট্য
শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য কর্মসূচী
শিশুর  মানসিক বিকাশে মস্তিষ্কের ভূমিকা
শিশু
শিশু আমাদের ভীষন আদরের। শিশু সম্পর্কে আমাদের বিভিন্ন জনের বিভিন্ন ধারণা। আমরা জানি, শিশু আমাদের আগামী দিনের ভবিষ্যত। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী শূন্য থেকে ১৮ বছরের কমবয়সী সকল মানব সন্তানকেই শিশু মনে করা হয়। বাংলাদেশ সরকারও এই সনদে সাক্ষর করেছে এবং নীতিগতভাবে শিশুর এই বয়সকে (১৮ বছর) অনুমোদন করে নিয়েছে। কিন্তু এই সনদে এও বলা হয়েছে যদি কোন দেশ তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শিশুর এই বয়সসীমাকে পরিমার্জন করতে চায় তাহলে তা করতে পারে। এরই উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ সরকার যে শিশু নীতিমালা প্রণয়ন করেছে সেখানে শূন্য থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত সকলকেই শিশু ধরা হয়েছে যাতে প্রয়োজনবোধে কোনো পরিবার যদি তাদের শিশুদের কাজে নিয়োজিত করতে চায় তাহলে যেন তা করতে পারে। সেক্ষেত্রে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের ঝুঁকিবিহীন কাজে এবং ১৬ বছর বয়সী শিশুদের পেশাগত নিরাপত্তা প্রদানসহ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করা যাবে। কিন্তু ভোট, বিয়ে এই সব বিষয়ে ১৮ বছর বয়সকেই সীমা হিসেবে ধরা হয়েছে।
প্রারম্ভিক শৈশবকাল
যে কোনো জিনিসের ভিত্তি স্থাপিত হয় শুরুতে বা প্রারম্ভে। শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশের ক্ষেত্রেও মূল ভিত্তি রচিত হয় প্রথম শৈশব বা প্রারম্ভিক শৈশবকালে। শিশুর প্রথম জীবন বা প্রারম্ভিক শৈশবকাল (Early Childhood) বলতে গর্ভাবস্থা থেকে পাঁচ বছর বয়সকে বোঝায়। এই সময়ের মধ্যেই একটি শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের ভিত্তি তৈরি হয়। এই সময়ে শিশু ভূমিষ্ট হয়ে শারীরিকভাবে বাড়তে থাকে এবং শারীরিক বৃদ্ধির পাশাপাশি তার আচরণগত দিকেও পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এ সময়কালে সে যা শেখে এবং যেভাবে শেখে তার ওপরই গড়ে ওঠে তার ভবিষ্যত বুদ্ধিমত্তা, ব্যক্তিত্ব, নৈতিক ও সামাজিক আচরণ। সে কারণেই এ সময়কালটি শিশুর জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের এই সময়ের মধ্যেই শিশুর সার্বিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তবেই তা শিশুর ভবিষৎ জীবনকে পরিপূর্ণ ও অর্থবহ করে তুলবে।
সম্পূর্ণ শিশুর বৈশিষ্ট্য
শরীর ও মন নিয়ে শিশুর সামগ্রিক গঠন। শরীরের হয় বৃদ্ধি আর মনের হয় বিকাশ। শিশুকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শারীরিক বৃদ্ধির পাশাপাশি চাই মানসিক বা মনের বিকাশ।
শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ
শারীরিক বৃদ্ধি
শরীরের বৃদ্ধি বলতে বিভিন্ন অংগ-প্রত্যঙ্গের আকার ও আকৃতি পরিবর্তন ও ওজন বৃদ্ধি হওয়াকে বোঝায়।
মানসিক বিকাশ
মনের বা মানসিক বিকাশ বলতে শিশুর জ্ঞান, মেধা, বুদ্ধি, আবেগ ও সামাজিক সম্পর্কের বিকাশকে বোঝায়। মানসিক বিকাশের সবচেয়ে মূল্যবান সময় হচ্ছে শিশুর জীবনের প্রথম বছরগুলো। এ সময়েই শারীরিক বৃদ্ধির পাশাপাশি একটি শিশু ক্রমশঃ তার বিভিন্ন অংগের ব্যবহার এবং ভাষা, চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি ও ভাবের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে অধিক দক্ষতা অর্জন করে।
মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রসমূহকে নিম্নিলিখিত ৬টি ভাগে ভাগ করা যায়
◆ জ্ঞান বুদ্ধির বিকাশঃ জন্মের পর থেকে শিশু কোনো কিছুর প্রতি গভীর মনোযোগ দেয়া, বুঝতে চেষ্টা করা, মনে রাখা, চিন্তা করে কোনো কথা বলা, কোনো সমস্যার সমাধান করা এ সব করার ক্ষমতাই হল জ্ঞান বুদ্ধির বিকাশ।
◆ ভাষাগত বা যোগাযোগ ভিত্তিক বিকাশঃ ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে মা-বাবার কথা বোঝা, এক বা দুই শব্দ বলা, ছোট ছোট বাক্য বলতে পারা এবং পরবর্তীতে সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলা এবং লিখতে পারাই হচ্ছে ভাষার বিকাশ।
◆ চলনক্ষমতার বিকাশঃ জন্মের পর থেকে হাত-পা নাড়াতে পারা, ধীরে ধীরে বসতে, হাঁটতে, দৌড় দিতে পারা, কোনো কিছু ধরতে পারা, লাথি মারা, ভারসাম্য রাখতে পারা ইত্যাদি হচ্ছে শিশুর চলনক্ষমতার বিকাশ।
◆ আবেগমূলক বিকাশঃ খুশী হলে হাসা, ব্যথা পেলে কাঁদা, কোন কিছু চেয়ে না পেলে জেদ ধরা ইত্যাদি শিশুর আবেগের প্রকাশ। এভাবে ভালো লাগা, মন্দ লাগা, আবেগ-অনুভূতি সঠিকভাবে প্রকাশ করা এবং প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জনই হচ্ছে শিশুর আবেগমূলক বিকাশ।
◆ সামাজিক বিকাশঃ জন্মের পর থেকে বয়স অনুযায়ী শিশুর মা-বাবা, ভাই-বোনের পাশাপাশি অন্যদের সাথে মিশতে পারার ক্ষমতা এবং ধীরে ধীরে পরিবারের ও সমাজের রীতি-নীতি, নিয়ম-কানুন অনুযায়ী খাপ খাইয়ে চলতে পারার ক্ষমতাই সামাজিক বিকাশ।
◆ আত্মসচেতনতামূলক বিকাশঃ জন্মের পর একটি শিশু পুরোপুরি অন্যের উপর নির্ভর করে বেড়ে উঠতে থাকে। এক পর্যায়ে সে কিছু কিছু কাজ নিজে করতে শেখে। যেমন- খাওয়া, জামা-জুতা পরা বা খোলা, নির্দিষ্ট স্থানে পায়খানা-প্রস্রাব করা ইত্যাদি। এছাড়াও এসময়েই আস্তে আস্তে তার পছন্দ- অপছন্দ, ভাল লাগা ইত্যাদি গড়ে ওঠে এবং নিজের সম্পর্কে সচেতন হয়। এটাই আত্মসচেতনতামূলক বিকাশ।
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য কর্মসূচী
বর্তমানে আমাদের দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে নিম্নলিখিত কর্মসূচীগুলি চালু রয়েছে।
কর্মসূচী
গর্ভকালীন যত্ন
প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী যত্ন
জন্ম নিবন্ধীকরণ
শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো
টিকা কর্মসূচী
পরিপূরক খাবার খাওয়ানো
ভিটামিন এ
চিকিৎসা সংক্রান্ত সেবা
আয়োডিন ঘাটতি জনিত রোগ প্রতিরোধ
প্রয়োজনীয় সেবা
বাড়তি খাবার, টিটি টিকা, নিরাপদ প্রসবের প্রস্তুতি, আয়রন বড়ি প্রদান, ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষণগুলো চিহ্নিতকরণ
নিরাপদ প্রসব, জরুরী প্রসূতি সেবা, প্রসব পরবর্তী চেকআপ
শিশুর জন্ম নিবন্ধন করা
শালদুধ সহ শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো
৭টি প্রতিরোধযোগ্য রোগের জন্য
বুকের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক শিশুর ৬ মাস বয়স পূর্ণ হবার পর খাবার
টিকা কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত
যেমন: খাবার স্যালাইনের মাধ্যমে ডায়রিয়ার চিকিৎসা, সর্দি-কাশি এবং শ্বাস কষ্টের চিকিৎসা কর্মসূচী এবং অন্যান্য চিকিৎসা
আয়োডিনযুক্ত লবণ
যে সময়ে দেয়া হয়
মাকে গর্ভাবস্থায়
মায়ের প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী অবস্থায়
জন্মের পরপরই
শিশুর ৬ মাস বয়স পর্যন্ত
শিশুর দেড় মাস থেকে ১ বছর বয়সের মধ্যে
শিশুর ৯ মাস বয়স পূর্ণ হলে হামের টিকা সাথে এবং জাতীয় টিকা দিবস পালনের সময়
অসুস্থকালীন সময়ে
মায়ের খাবার ও শিশুর ৬ মাস বয়স থেকে পরিপূরক খাবারের সাথে
এই কর্মসূচীগুলোকে বিশে-ষন করলে দেখা যায় যে এগুলো মূলতঃ শিশুর শারীরিক বৃদ্ধির চাহিদা পূরণ করছে। শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য বড় ধরনের কোন কর্মসূচী আমাদের দেশে চালু নেই বললেই চলে। উপরোক্ত চালু কর্মসূচীগুলিকে আরও জোরদার করে তোলার জন্য আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে যাতে এই সেবা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যাদি এবং সেবাগুলো জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়। এর পাশাপাশি শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য নতুন কর্মসূচী হাতে নিতে হবে।
শিশুর  মানসিক বিকাশে মস্তিষ্কের ভূমিকা
মানসিক বিকাশ কিভাবে হয়
জীবনের প্রথম বছরগুলো হচ্ছে শিশুর মানসিক বিকাশের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। এ সময়ে সে যা শেখে এবং যেভাবে শেখে তার ওপরই গড়ে ওঠে শিশুর ভবিষ্যত বুদ্ধিমত্তা, ব্যক্তিত্ব, নৈতিক ও সামাজিক আচরণ। মানসিক এ কর্মকান্ডগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে মস্তিষ্ক। তাই মানসিক বিকাশ নির্ভর করে মস্তিষ্কের বিকাশের ওপর।
মস্তিষ্ক বিকাশের তথ্য
◆ মস্তিষ্কের কোষই হল কাজ করার মূল উপাদান।
◆ শিশু যখন মায়ের গর্ভে থাকে তখনই তার মস্তিষ্কের কোষের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। কোষের সংখ্যা সুষ্ঠুভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য গর্ভবতী মায়ের সুষম খাবার, শারীরিক সুস্থতা, বিশ্রাম ও মানসিক প্রশান্তির প্রয়োজন।
◆ একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন তার মস্তিষ্কে কোটি কোটি কোষ থাকে। জন্মের পর এই কোষের সংখ্যা আর বাড়ে না।
◆ মস্তিষ্কের কোষগুলোর কাজ করার অনেক সম্ভাবনা থাকলেও এরা এককভাবে কোন কাজ করতে পারে না, এজন্য প্রয়োজন এক কোষের সাথের অন্য কোষের সংযোগ। এই সংযোগের উপরই নির্ভর করে মস্তিষ্কের কাজ করার ক্ষমতা তথা শিশুর পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ।
◆ মস্তিষ্কের কোষের সংযোগের শতকরা ৮০-৯০ ভাগ জন্ম থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যেই ঘটে। তবে জীবনের প্রথম তিন বছরের মধ্যে এই সংযোগ সবচেয়ে বেশী মাত্রায় ঘটে।
◆ এই সংযোগের ওপরই নির্ভর করে শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ। মস্তিষ্কের কোষগুলোর মধ্যে সংযোগ ঘটানোর জন্য মস্তিষ্কের কোষগুলোকে সক্রিয় (Active) করা প্রয়োজন।
◆ কোষের সক্রিয়তার জন্য প্রযোজন কোষকে উদ্দীপ্ত (Stimulate) করা। আর পাঁচটি ইন্দ্রিয়কে কাজে লাগানো যেতে পারে, এমন পারস্পরিক ক্রিয়ার (Interaction) মাধ্যমেই শিশুর মস্তিষ্কের সব অংশের কোষগুলোকে উদ্দীপ্ত করা যায়।
◆ পারস্পরিক ক্রিয়ামূলক যত্নের (Interactive care) মাধ্যমেই শিশুর সাথে পারস্পরিক ক্রিয়া ঘটে।
তথ্যসুত্রঃ (পরিবার কল্যাণ সহকারী এবং পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক সহায়িকা)

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url