ক্রায়োসার্জারি কি - ক্রায়োসার্জারির ব্যবহার
ক্রায়োসার্জারি কি
ক্রায়োসার্জারি হচ্ছে এক প্রকার চিকিৎসা পদ্ধতি যার মাধ্যমে অত্যাধিক শীতল তাপমাত্রা প্রয়োগ করে ত্বকের অস্বাভাবিক এবং রোগাক্রান্ত টিস্যু ধ্বংস করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ সালের দিকে মিশরীয়রা ত্বকের বিভিন্ন ধরনের ক্ষত ও প্রদাহের চিকিৎসায় শীতল তাপমাত্রার ব্যবহার করতেন। আবার নেপোলিয়নের বিখ্যাত শাস্ত্রচিকিৎসক ডমিনিক জ্যা ল্যারি অঙ্গছেদনের কাজে শীতল তাপমাত্রার ব্যবহার করতেন। ত্বক, গ্রীবাদেশীয় এবং স্তন ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলোকে জমাট বাধানোর জন্য ইংল্যান্ডের চিকিৎসক জেমস্ আরনোট লবণ এবং বরফের একটি মিশ্রণ তৈরি করে তা ১৮° সে. থেকে ২৪° সে. তাপমাত্রায় প্রয়োগ করতেন। নিউ ইয়র্কের চিকিৎসক ক্যাম্পবেল হোয়াইট ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম শীতল তাপমাত্রা দ্বারা বিভিন্ন ধরনের ত্বকের চিকিৎসার জন্য তরল গ্যাস ব্যবহার করেন। হোয়াইট হাউস এবং নিউ ইয়র্কের রিপোর্টে ১৯০৭ সালে ১৫ জন ত্বক ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় ক্রায়োসার্জারির প্রায় সফল প্রয়োগের উল্লেখ্য পাওয়া যায়। এরপর শিকাগোর চিকিৎসক উইলিয়াম পসি ক্রায়োসার্জারিতে কঠিন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের প্রবর্তন করেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কঠিন কার্বন-ডাই-অক্সাইড ব্যাপকভাবে ক্রায়োসার্জারিতে ব্যবহৃত হয়। এরপর ১৯২০ সালের দিকে ক্রায়োসার্জারিতে তরল অক্সিজেনের ব্যবহার শুরু হয়।
১৯৫০ সালে ড: রে এলিংটন ক্রায়োসার্জারিতে তরল নাইট্রোজেন প্রয়োগ করেন। ড: ইরভিং কুপার এবং আনোও নির হাত ধরে আধুনিক ক্রায়োসার্জারির যাত্রা শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে তরল নাইট্রোজেন (-১৯৬°C) এবং অন্যান্য ক্রায়োজেনিক এজেন্ট যেমন-তরল নাইট্রাস অক্সাইড (+৯°C), তরল কার্বন-ডাই-অক্সাইড (-৭৯°C), ডাল আর্থন (20°C), ইথাইল ক্লোরাইড, ডাই মিথাইল ইথার-প্রপেন (-৪১°C) এবং ফ্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন ইত্যাদি ব্যবহার করে ক্রায়োসার্জিক্যাল চিকিৎসার আরও উন্নতি সাধন করা হয়।
ক্রায়োসার্জারি পদ্ধতি/কৌশল/উপায়
ক্রায়োসার্জারি কৌশল প্রয়োগ করে চিকিৎসা করাকে ক্রায়োথেরাপি বলে। ক্রায়োথেরাপিতে টিউমার টিস্যুর তাপমাত্রা ১২ সেকেন্ডের ভিতরে কমিয়ে - ১২০ থেকে ১৬৫° সে. তাপমাত্রায় নিয়ে আসা হয়। এই সময় ক্রায়োপ্রোব বা একটি সূচের প্রান্ত দ্বারা টিউমার টিস্যুর ভিতরে খুব দ্রুত তরল আর্গন গ্যাসের নিঃসরণ করানো হয়। তাপমাত্রার অত্যাধিক হ্রাসের ফলে কোষের পানি জমাটবদ্ধ হয়ে ঐ টিস্যুটি একটি বরফপিন্ডে পরিণত হয়। বরফ পিন্ডের ভেতরে টিউমার টিস্যুটি আটকা পড়ে গেলে এতে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ ১৬৫ সে. তাপমাত্রায় রক্ত ও অক্সিজেন পরিবহন সম্ভব নয়। এর ফলে জমাটবদ্ধ অবস্থায় টিউমার টিস্যুটির ক্ষয় সাধিত হয়। আবার ক্রায়োপ্রোব বা সুঁচের প্রান্ত দিয়ে টিউমার টিস্যুটির ভিতরে হিলিয়াম গ্যাস নিঃসরণের মাধ্যমে টিস্যুটির তাপমাত্রা ২০°সে থেকে ৪০ সে. এ উঠানো হয়। তখন জমাটবদ্ধ টিউমার টিস্যুটির বরফ গলে যায় এবং টিস্যুটি ধ্বংস হয়ে যায়।
ক্রোয়োসার্জারিতে চিকিৎসক টিউমার টিস্যুর তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধি এবং বরফ খন্ডের আকার আকৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। ক্রায়োসার্জারিতে তাপমাত্রা হ্রাসবৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি অন্তত দু'টি চক্রে সম্পন্ন হয়। শীতলীকরণ প্রক্রিয়াটি ততক্ষণ যাবৎ চলতে থাকে যতক্ষণ না পুরো টিউমারটি এবং এর আশপাশের টিস্যু ৫-১০ মি. মি. পুরু বরফ দ্বারা ভালভাবে আবৃত হয়। বড় টিউমারের ক্ষেত্রে একাধিক শীতলীকরণ সূচ ব্যবহার করতে হয়। প্রয়োজন সাপেক্ষে এই প্রক্রিয়াটি দুই থেকে তিনবার সম্পন্ন করা হয়।
প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে বর্তমানে খুব সরু (আন্ট্রা থিন) ক্রায়ো সূঁচ ব্যবহারের মাধ্যমে বরফ প্রয়োগের প্রক্রিয়া অত্যন্ত সুচারু রূপে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। ফলে জটিলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা একেবারে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। শরীরের অভ্যন্তরে টিউমারের ক্ষেত্রে চিকিৎসা প্রদানের আগে ট্রান্সরেকটাল আলট্রাসাউন্ড বা ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (MRI) পদ্ধতির সাহায্যে টিউমারের সঠিক অবস্থান ও আয়তন নির্ধারণ করে নেওয়া হয়। এ ধরনের ইমেজিং পদ্ধতির সাহায্যে ক্রায়ো প্রোবটির গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে সুস্থ কোষগুলোকে প্রভাবমুক্ত রাখা এবং চলমান প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। ক্রায়োসার্জারিতে ব্যবহৃত অন্যান্য উপকরণগুলো হলো- আল্ট্রা সাউন্ড, ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজ বা কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি, স্প্রে ডিভাইস, কটন বাট, ব্রাঙ্কোস্কোপ ইত্যাদি।
ক্রায়োসার্জারি ব্যবহার/প্রয়োগ
ত্বকের ছোট টিউমার, তিল, আচিল, ত্বকের ছোট ছোট ক্যান্সার ইত্যাদি ক্রায়োসার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। এছাড়াও ক্রায়োসার্জারির দ্বারা অভ্যন্তরীণ কিছু রোগ যেমন-যকৃত ক্যান্সার, বৃত্ত ক্যান্সার, প্রস্টেট ক্যান্সার, ফুসফুস ক্যান্সার, মুখের ক্যান্সার, গ্রীবাদেশীয় গোলযোগ, পাইলস ইত্যাদির চিকিৎসাও করা হয়। Plantar Fascitis এবং Fibroma ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ক্রায়োসার্জারির প্রয়োগ দেখা যায়। ক্রায়োসার্জারিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার/প্রয়োগ-
• ক্রায়োসার্জারি নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা তাদের মধ্যে মতবিনিময় ও গবেষণার ফলাফল বিনিময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ।
• রোগীর বিভিন্ন তথ্য, ক্রায়োসার্জারি সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল ইত্যাদি সংরক্ষণ করার জন্য ডেটাবেজ সিস্টেম ব্যবহৃত হতে পারে।
• ক্রায়োসার্জারি প্রক্রিয়ার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সিস্টেম ব্যবহৃত হতে পারে।
• বর্তমানে পুরো ক্রায়োসার্জারি প্রক্রিয়াটি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত রোবটের মাধ্যমেও সম্পন্ন করা যেতে পারে।
ডাক্তারদের প্রশিক্ষণের জন্য ক্রায়োসার্জারি সিম্যুলেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার করা যেতে পারে।
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url